আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মোঙ্গল আক্রমণের ফলাফল” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
মোঙ্গল আক্রমণের ফলাফল :
মোঙ্গলরা ছিল স্বভাবে হিংস ও রক্তপিপাসু। স্বভাবতই ভারতের বিরুদ্ধে মোঙ্গলদের সফল অভিযানগুলির একমাত্র ফল ছিল ভারতের অসংখ্য নিরীহ প্রাণের বিনাশ এবং সম্পদের লুণ্ঠন। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব (A. L. Srivastave) এই সহজ-সরল ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে রক্তপিপাসু মোঙ্গলদের আক্রমণের মধ্যে একটা শুভ সম্ভাবনার আভাস লক্ষ্য করেছেন। ‘The Sultanate of Delhi’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে, মোঙ্গলরা ভারতের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পেলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় থেকে ভারতবর্ষ রক্ষা পেত। তাঁর মতে, মোঙ্গলরা সফল হলে দিল্লি-সুলতানির পতন ঘটত। এবং যেহেতু মোঙ্গলরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল, তাই তারাও গ্রীক, শক বা হুনদের মতোই একদিন ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করে এদেশের সমাজ-সংস্কৃতির সাথে একাকার হয়ে যেত। তিনি লিখেছেন যে, “Had the Mongols succeeded, the history of our country would have taken a different course. The Sultanate would have come to an end, and the Mongols being virtual Buddhists would have gradually merged in the Hindu society…”
শ্রীবাস্তবের এই মুল্যায়ন নেহাতই কষ্টকল্পনা মাত্র। কারণ মোঙ্গলদের মধ্যে যে সহিষ্ণুতা ও সমন্বয়ী আদর্শের একান্ত অভাব ছিল, তা অধ্যাপক শ্রীবাস্তব তাঁর বিবেচনার মধ্যে রাখেননি। মধ্য-এশিয়ার সুসজ্জিত নগরী ও জনপদগুলি আক্রমণ করে মোঙ্গলরা যে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছিল, তার পরিণামে আশ্রয়ের সন্ধানে দলে দলে মানুষ ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। দিল্লি দখল করলেও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত, অন্য কিছু নয়। এই প্রসঙ্গে মোঙ্গলদের জীবনদর্শন সম্পর্কে মাইকেল প্রাউডিন তাঁর ‘The Mughol Empire; its Rise and Fall’ গ্রন্থে যে তথ্য দিয়েছেন, তা লক্ষণীয়। মানুষ জীবনের সর্বাধিক আনন্দ প্রসঙ্গে স্বয়ং চেঙ্গিজ খাঁ মন্তব্য করেছিলেন, “একজন মানুষের সর্বাধিক আনন্দ হল শত্রুদের জয় করা ও তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। তাদের ঘোড়ায় আরোহণ করা ও সম্পদ লুঠ করা। তাদের প্রিয়জনদের চোখের জলে ভরা মুখ দেখা এবং তাদের স্ত্রী-কন্যাদের নিজ বাহুবন্ধনে জড়ানো।” তাই মোঙ্গলদের আক্রমণ প্রতিহত করে এবং আক্রমণের সম্ভাব্যতা হ্রাস করার জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যথেষ্ট দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।
মোঙ্গল আক্রমণের ভীতি দিল্লির সুলতানদের সদা বিব্রত রেখেছিল। এর ফলে সীমান্ত নিরাপত্তা বিধানে ব্যয়িত হয়েছিল প্রভূত সম্পদ, শক্তি ও সময়। তবে মোঙ্গলদের উত্থান পরোক্ষভাবে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গুরুতর পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। মধ্য-এশিয়ার মোঙ্গলদের উত্থান ও ক্ষমতা দখলের ফলে সেখানকার রাজ্যগুলি থেকে বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি ও ভাগ্যান্বেষী সৈনিক দিল্লিতে চলে এসেছিলেন। এদের আগমনে দিল্লির তুর্কি-অধ্যুষিত রাজধানীতে অস্থিরতা দেখা দেয়, এবং খলজিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপটে মধ্য-এশিয়ায় মোঙ্গল আক্রমণের গুরুত্ব বিবেচনা করা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
খলজি আমলে মোঙ্গল আক্রমণ :
মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার কাজে জালালউদ্দিন ফিরোজ দক্ষতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন। ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রাক্তন মোঙ্গল নেতা হলাকু’র পৌত্র আবদুল্লার নেতৃত্বে প্রায় দেড় লক্ষ মোঙ্গলের একটি দল ভারত আক্রমণ করে এবং সামানা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। জালালউদ্দিন তৎপরতার সঙ্গে মোঙ্গলদের গতিরোধ করেন এবং যুদ্ধে পরাজিত করে পিছু হটতে বাধ্য করেন। এই সময় চেঙ্গিজ খাঁ’র বংশধর হুলাকু’র নেতৃত্বে কয়েক হাজার মোঙ্গল ইসলামধর্ম গ্রহণ করে ভারতে বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ফিরোজ তাদের সেই অনুমতি দেন। এমনকি তিনি নিজের ভগিনীর সাথে হলাকু’র বিবাহ দেন এবং ধর্মান্তরিত মোঙ্গলদের বিভিন্ন সরকারি পদে নিয়োগ করেন। এরা ‘নব-মুসলমান’ নামে পরিচিত হয়। জালালের এই কাজের মধ্যে দূরদৃষ্টির অভাব লক্ষ্য করা যায়। কারণ পরবর্তীকালে এই ‘নব-মুসলমানরা দিল্লি-সুলতানির অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।