আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্যযুগে কৃষি অর্থনীতির সম্প্রসারণ” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
মৌর্যযুগে কৃষি অর্থনীতির সম্প্রসারণ
মৌর্যযুগে পশুচারণ অর্থনীতির পরিবর্তে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি সুস্পষ্ট ও দৃঢ় ভিত্তি পায়। মৌর্যকালীন অর্থনীতির মূল ভিত্তিই ছিল কৃষিজ উৎপাদন। অশোকের বিভিন্ন শিলালেখতে কৃষির গুরুত্ব বিষয়ে আভাস দেওয়া হয়েছে। তবে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। মেগাস্থিনিসের রচনা থেকেও কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। একাধিক নদনদীর অবস্থান এবং বছরে দু’বার বর্ষার কারণে নানা ধরনের ফসল উৎপাদন সম্ভব ছিল। তাঁরা লক্ষ্য করেছেন যে, বর্ষাযুক্ত অঞ্চলে দু’বার ফসল ফলানো যেত এবং শুকনো এলাকায় জলসেচ দ্বারা দ্বিতীয়বার উৎপাদন করা সম্ভব হত। তবে এই সুযোগ উত্তর ভারতেই ছিল বেশি। মৌর্যদের আমলেই সর্বপ্রথম ভারতের দু’টি প্রধান নদী গঙ্গা ও সিন্ধু এবং তাদের উপনদীগুলি বিধৌত অঞ্চল একই শাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে স্থাপিত হয়েছিল। গাঙ্গেয় উপত্যকার পলি বিশিষ্ট জমি ছিল বিশেষ ভাবে উর্বর। লোহার আবিষ্কার এবং লৌহ নির্মিত লাঙ্গলের ব্যবহার কৃষি কাজ ও উৎপাদনের কাজে গুণগত পরিবর্তন এনেছিল।
গ্রীক লেখকদের রচনা থেকে এমন আভাস পাওয়া যায় যে, জমিতে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত ছিল না, সকল জমির মালিক ছিলেন স্বয়ং রাজা। কিন্তু বিষয়টি সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ কৌটিল্য তাঁর গ্রন্থে জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ মীমাংসার উল্লেখ করেছেন। ব্যক্তি মালিকানার অস্তিত্ব না থাকলে এধরনের বিবাদের প্রসঙ্গ আসা সম্ভব নয়। সম্ভবত অধিকাংশ জমিই রাজকীয় মালিকানায় ছিল। অর্থশাস্ত্রে এগুলিকে রাজার খাস বা ‘সীতা’ জমি নামে অভিহিত করা হয়েছে। অসংখ্য দাস ও বেতনভূক কৃষি শ্রমিকের (মজুর) সাহায্যে ‘সীতাধ্যক্ষ’ নামক কর্মচারী এই সকল জমির কৃষিকাজ তত্ত্বাবধান করতেন। সীতাধ্যক্ষর প্রধান দায়বদ্ধতা ছিল কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কাজ সুনিশ্চিত করা। কৌটিল্য স্পষ্ট বলেছেন যে, রাজকীয় অধিকারে কেবল ভূসম্পদ (জমি) থাকাই যথেষ্ট নয়, সেই জমির সদ্ব্যবহার অর্থাৎ উৎপাদন সুনিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই কাজ করতে দায়বদ্ধ ছিলেন সীতাধ্যক্ষ। ডি. এন. ঝা লিখেছেন যে, মৌর্য রাষ্ট্রের অধীনে বহু বৃহদায়তন কৃষিক্ষেত্র ছিল। রাষ্ট্রীয় কৃষিক্ষেত্রের অধ্যক্ষ কৃষির নতুন পদ্ধতি কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেন। তিনিও রাজার খাস জমির পাশাপাশি করদাতাদের ব্যক্তিগত কৃষির উল্লেখ করেছেন।
কৃষি অর্থনীতি বিকাশের প্রেক্ষাপটে কৌটিল্য কথিত ‘জনপদনিবেশ নীতি’র বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ‘জনপদনিবেশ” হল নতুন নতুন গ্রামীণ এলাকায় বসতি স্থাপনের মাধ্যমে পতিত বা অনাবাদী জমিকে কৃষি অর্থনীতির আওতায় নিয়ে আসা। যে সকল অঞ্চল একদা জন অধ্যুষিত ছিল এবং পরে পরিত্যক্ত হয়েছে, কিংবা যে সকল এলাকায় অতীতে জনবসতি গড়ে ওঠেনি, এমন এলাকাগুলিতে ‘জনপদনিবেশ’ নীতি প্রয়োগের প্রয়াস নেওয়া হয়। রাজ্যের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে কিছু পরিবারকে নতুন এলাকায় স্থানান্তরিতকরণ কিংবা যুদ্ধবন্দীদের নতুন এলাকায় পুনর্বাসন দিয়ে জনপদনিবেশ নীতি কার্যকর করা সম্ভব বলে কৌটিল্য মনে করতেন। তাঁর মতে, এই জটিল ও ব্যাপক কর্মকাণ্ড সরকারী উদ্যোগেই বাস্তবায়িত করা সম্ভব। নতুন জনপদগুলিতে বসবাসের জন্য মূলত কৃষিজীবী শূদ্র গোষ্ঠীভুক্তদের প্রাধান্য দেওয়া হয় (শূদ্রকর্ষকপ্রায়)। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করাই যেহেতু জনপদনিবেশ নীতির মূল লক্ষ্য ছিল, সেহেতু এই সকল এলাকার অধিকাংশ জমি সরকার কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়। কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্রে’ স্পষ্ট লিখেছেন যে, কৃষিকাজে অনিচ্ছুক কৃষকদের জন্য জমি বরাদ্দ করা উচিত নয়। তাঁর বিধান হল, এমন কৃষকদের জন্য বরাদ্দ জমি উদ্যোগী কৃষকদের হাতে পুনর্বণ্টন করা উচিত।
মৌর্য যুগে সম্প্রসারিত কৃষি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল ব্যাপক জলসেচ ব্যবস্থা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে সেচব্যবস্থা রূপায়ণের কাজে সরকারের বিশেষ উদ্যোগের উল্লেখ আছে। সেচ ব্যবস্থার কাজ তত্ত্বাবধান করা এবং কৃষি জমিতে সেচের জল পৌঁছে দেবার কাজে ‘এ্যাগ্রোনময়’ নামক কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে সেচখাল খনন এবং জলাধার নির্মাণ করার কাজে সরকারী উদ্যোগের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্র সহ প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে জলসেচ প্রকল্পকে ‘সেতু’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কৌটিল্য প্রাকৃতিক জলসেচ (সহোদক সেতু) অর্থাৎ বৃষ্টি ও নদীর জল এবং কৃত্রিম জলসেচ (আহার্যদোক সেতু) যেমন জলাধার নির্মাণ, সেচখাল খনন ইত্যাদি দু’প্রকার জলসেচ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। জলসেচের সুবিধাভোগী কৃষকদের ‘উদভাগ’ নামক একপ্রকার জলকর আদায়ের কথা অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই করের কোন নির্দিষ্ট হারের উল্লেখ অর্থশাস্ত্রে নেই। সম্ভবত জলগ্রহণের পরিমাণ এবং কোন ধরনের ব্যবস্থা দ্বারা সেচ গ্রহণ করা হচ্ছে, তার ভিত্তিতেই করের হারে তারতম্য ঘটত। তবে ‘উদকভাগ’ সরকার আদায় করত কিনা এ বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই। অর্থশাস্ত্র ছাড়া অন্য কোন সূত্রে এর উল্লেখ নেই। সরকারী উদ্যোগে নির্মিত বৃহৎ জলাধার হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে সৌরাষ্ট্রে নির্মিত সুদর্শন হ্রদটি উল্লেখযোগ্য। রুদ্রদামনের জুনাগড় লেখতে (১৫০ খ্রিঃ) এই খালটির বিস্তারিত বিবরণ আছে। অশোকের আমলে কয়েকটি নতুন সেচখাল দ্বারা এই হ্রদের জল সরবরাহ সম্প্রসারণ করা হয়। ডি. আর. ভাণ্ডারকর (D. R. Bhandarkar) মধ্যপ্রদেশের বেমনগরে (বিদিশা) উৎখনন চালিয়ে মৌর্য আমলে নির্মিত একটি সেচ প্রণালীর অবশেষ আবিষ্কার করেছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এত বড় সেচপ্রণালী খনন বা রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয় বলেই ভাণ্ডারকর মনে করেন। অবশ্য মৌর্য আমলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিংবা গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলির যৌথ উদ্যোগে জমিতে জলসেচ ব্যবস্থার আভাস অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায়। জমিতে কূপ বা পুকুর কাটিয়ে জলসেচ দেওয়ার উদ্যোগ সক্রিয় ছিল।
মৌর্য পরবর্তী প্রায় পাঁচশো বছর (খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ) ভারতীয় উপমহাদেশে কোন বৃহৎ রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল না। এই পর্বের ঐতিহাসিক গুরুত্ব হল যে এই সময় বহিরাগত রাজনৈতিক শক্তি ভারতে ছোট ছোট রাজ্য গঠন করতে সক্ষম হয়। এর ফলে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া, চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ গভীর হয়। ভারতীয় রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনীতির উপরেও এর প্রভাব দেখা যায়। আলোচ্য সময়কালে কৃষি অর্থনীতির কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি। বছরে দুবার ফসল উৎপাদনের ধারা এ যুগেও অব্যাহত ছিল। পানিনি তাঁর ব্যাকরণে গ্রীষ্মকালীন ও শরৎকালীন ফসলের জন্য পৃথক শব্দ ব্যবহার করেছেন। মৌর্য যুগে উত্তর ভারতে বিশেষত গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে কৃষি ছিল মানুষের প্রধান বৃত্তি। মৌর্য্যোত্তর পাঁচশো বছরে নতুনত্ব হল যে, এখন দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে কৃষি-কর্মের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে। বিভিন্ন উৎখনন থেকে লৌহ নির্মিত লাঙ্গল, কুঠার, কোপানি, দা ইত্যাদি সরঞ্জাম আবিষ্কৃত হয়েছে। তক্ষশিলা, সাঁচী প্রভৃতি স্থানের উৎখনন লৌহ সরঞ্জাম ব্যবহারের ব্যাপকতা প্রমাণ করে। নিঃসন্দেহে এটি দ্রুত কৃষি সম্প্রসারণের সহায়ক হয়েছিল। গান্ধারের একটি ভাস্কর্যে (ব্রিটিশ শতকের গোড়ায়) বলদের সাহায্যে হলকর্ষণরত এক কৃষকের প্রতিকৃতি দেখা যায়। এমনকি ‘মিলিন্দপঞহো’ গ্রন্থেও কৃষিকাজের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা স্থান পেয়েছে। তেমন, জমি পরিষ্কার, মাটি খনন, বীজ বপন, জলসেচ, জমিতে বেড়া দেওয়া, ফসল কাটা ইত্যাদির ধারাবাহিক বর্ণনা উন্নত কৃষিমনস্কতা ও কৃষিকাজের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়।
দক্ষিণ ভারতে কৃষি অর্থনীতির প্রসার এই পর্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। লোহার লাঙ্গল ব্যবহারের সূত্রে কৃষিতে গুণগত পরিবর্তন আসে। গ্রামে বসতি গড়ে তোলার নতুন নতুন উদ্যোগ দেখা যায়। দক্ষিণ ভারতে কৃষি অগ্রগতির মধ্যে কোশাম্বি রাজনীতির উপর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছেন। তাঁর মতে, এর ফলে ঐ অঞ্চলে ছোট ছোট দলপতির শাসনের পরিবর্তে রাজকীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উৎপাদিত খাদ্যশস্যের মধ্যে ধান, গম ও যবের স্থান ছিল প্রথম। দক্ষিণ ভারতে তুলো উৎপাদনের প্রাচুর্য দেখা যায়। সম্ভবত দাক্ষিণাত্যের কালো মৃত্তিকা তুলো চাষের উপযোগী ছিল। কেরালায় গোলমরিচসহ নানাবিধ মশলা উৎপাদন করা হত বলে সঙ্গম সাহিত্য ও গ্রীক বিবরণ থেকে জানা যায়। পতঞ্জলির গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, মগধে প্রচুর পরিমাণ চালের উৎপাদন এযুগেও অব্যাহত ছিল।
মৌর্য্যোত্তর পর্বের রাজবংশগুলিও জমিতে সেচদানের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং ব্যক্তিগত প্রয়াসে সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটেছিল। নদীর জল সংরক্ষণ এবং সেচ প্রণালীর মাধ্যমে সেই জল কৃষি জমিতে সরবরাহ করার কাজ ছিল বেশ জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। তাই বৃহৎ সেচপ্রকল্পগুলি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল। জলসেচ সম্পর্কে শাসকদের আগ্রহের প্রমাণ শক ক্ষত্রপ রুদ্রদামনের জুনাগড় লেখ থেকে পাওয়া যায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে কাথিয়াবাড়ে (সৌরাষ্ট্র) বৃহৎ জলাধার সুদর্শন হ্রদটি নির্মিত হয়েছিল। কিছুকাল পরে প্রাকৃতিক কারণে সেই বাঁধে ফাটল ধরলে সব জল বেরিয়ে যায়। রুদ্রদামন এই বাঁধের গুরুত্ব বিচার করে সত্বর এটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এই কাজের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন ছিল। তিনি ব্যক্তিগত সঞ্জয় থেকে অর্থ ব্যয় করে দ্রুত সুদর্শন বাঁধ মেরামত করে দেন। এলাহাবাদের সন্নিকটে শৃঙ্গবেরপুরে একটি উন্নত জলাধারের (ঔদকীয়) অবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত খালের মাধ্যমে গঙ্গা থেকে এখানে জল এনে দুটি স্বতন্ত্র জলাধারে রাখা হত। দুটি ইট নির্মিত জলাশয়ের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী একটি নালিও ছিল। তবে এই জল সেচের কাজে ব্যবহার করা হত কিনা, তা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই উন্নত জলাধারটি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিষ্টীয় ২০০ শতকের অন্তর্বর্তীকালে নির্মিত হয়েছিল। ‘বনবাসী লেখ’ থেকে জানা যায় যে, উত্তর কর্ণাটক অঞ্চলে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রাজকন্যা মহাভোজী শিবস্কন্দ নাগশ্রীর উদ্যোগে এবং অমাত্য স্কন্দস্বাতীর তত্ত্বাবধানে একটি পুষ্করিণী খনন করা হয়েছিল।
দক্ষিণ-ভারতেও নদীর জলকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সেচব্যবস্থার প্রচলনের কথা জানা যায়। প্রাচীন তামিল সাহিত্য অর্থাৎ সঙ্গম কাব্যের উল্লেখ থেকে জানা যায়, চোলরাজ কারিকল কাবেরী নদীর জল নিয়ন্ত্রণ করে কৃষিব্যবস্থার উন্নতিসাধন করেছিলেন।
জল-সংরক্ষণ, বাঁধ মেরামত, প্রণালী-খনন ও নিকাশীব্যবস্থা নির্মাণে দক্ষ কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষ শ্রমিকেরও অভাব ছিল না প্রাচীন ভারতে। প্রাচীন লেখ থেকে ‘ওদযান্ত্রিক’ বা জল ব্যবহারের যন্ত্রবিদের কথা এবং ‘অহরঘটিকা’ অর্থাৎ চক্রাকার ঘটি বসানো জল উত্তোলনের কথা জানা যায়। রাষ্ট্রের ও সাধারণ মানুষের সেচব্যবস্থার প্রতি সচেতনতা ও যান্ত্রিক জ্ঞানের সম্মিলনে প্রাচীন ভারতের সেচব্যবস্থা দ্রুত উন্নতিলাভ করেছিল এবং ভারতের কৃষি-অর্থনীতিকে একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করেছিল।
ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাতবাহন বংশের রাজত্বকালে একটি নতুনত্ব দেখা যায়, যার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া ছিল। সাতবাহন রাজারা ভূমিদান প্রথা চালু করেন। প্রধানতঃ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এবং ধর্মকর্মের সাথে যুক্ত মানুষজন যেমন, পুরোহিত, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী প্রমুখ নিষ্কর জমি ভোগের সুবিধা পেতে শুরু করেন। ভূমিদানের উল্লেখ সম্বলিত প্রাচীনতম লেখটি উৎকীর্ণ হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে। এই সময় বৈদিক যাগযজ্ঞে পৌরহিত্য করার জন্য সাতবাহন রাজারা ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতেন। প্রাথমিকভাবে জমি প্রাপকরা কেবল নিষ্কর জমি ভোগের অধিকার পেতেন। প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ যেমন করহার নির্ধারণ, কর আদায় ছিল রাজকীয় প্রশাসনের হাতে। ক্রমে দান-গ্রহীতারা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণও পেয়ে যান। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের একটি তাম্রশাসনে সাতবাহন রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী রাজকর্মচারীদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, সম্প্রদান করা ভূমি বা গ্রামের প্রশাসনে তাঁরা যেন হস্তক্ষেপ না করেন। এইভাবে দান করা ভূখণ্ড বা গ্রামকে কেন্দ্র করে রাজকীয় প্রশাসনের বাইরে ছোট ছোট শক্তির কেন্দ্র গড়ে উঠতে থাকে, যা পরবর্তীকালে রাজকীয় কর্তৃত্বকেই সংকটাপন্ন করেছিল।
সাতবাহন আমলে রাজ্যে কৃষি সম্প্রসারণের কাজে মূখ্য ভূমিকা ছিল ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার। দাবিদারহীন জমিতে যে ব্যক্তি শ্রমদান করছে, সেই হত জমির মালিক। সমকালীন গ্রন্থ মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে, একটি জায়গায় যে ব্যক্তি প্রথম জঙ্গল পরিষ্কার করছে বা শিকার করছে, উক্ত জমির মালিক হবে সেই ব্যক্তি। সমকালীন বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অসংখ্য কৃষক ব্যক্তিগতভাবে কঠোর পরিশ্রম করে কৃষি উৎপাদনের কাজে লিপ্ত ছিলেন। অনাবাদী জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার জন্যই সাতবাহন রাজারা এই সকল উদ্যোগকে সরকারীভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ডি. এন. ঝা’র মতে, ব্রাহ্মণদের ভূমিদানের পেছনেও প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কৃষি এলাকার সম্প্রসারণ। তাই কৃষির দিক থেকে উন্নত ও উর্বর এলাকাগুলিই দান হিসেবে দেওয়া হত।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।