আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্যযুগে জমির মালিকানা বিতর্ক ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভূমি” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
মৌর্যযুগে জমির মালিকানা বিতর্ক
খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৬০০ অব্দের মধ্যে পশুচারণ-অর্থনীতির পরিবর্তে স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজের বিকাশ ঘটেছিল। পরবর্তী-বৈদিক সাহিত্যগুলিতে এই রূপান্তরের আভাস পাওয়া যায়। রাষ্ট্রব্যবস্থার উন্মেষের ফলে কৃষিজমি থেকে কর আদায়ের ধারণার জন্ম হয়। যদিও ঋগ্বেদে কোথাও কৃষিজমি থেকে করের উল্লেখ নেই, কিন্তু পরবর্তী বৈদিক রচনাগুলিতে ভূমি দান, ভূমি ক্রয়, করদান সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। কৃষিজমিকে তখন বিলি করা হত গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত সদস্যদের মধ্যে। ফলে সম্পত্তির অধিকার ও সামাজিক পদমর্যাদার পার্থক্যের ভিত্তিতে সামাজিক অসাম্যের পথ সুগম হয়ে ওঠে। সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে উত্তরাধিকারের প্রশ্নটিও। ভূমির উপর অধিকারের দাবিতে ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং ঋগ্বৈদিক যুগের শুরুতে যা ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ, ক্রমে তাতে একটি ধনী ও বিশেষ সুবিধাভুক্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এই সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ প্রতিভূ ছিলেন রাজা। ক্রমে রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সম্পদের উপরেই রাজার ব্যক্তিগত ক্ষমতা বিস্তৃত হয় এবং এদের মধ্যে ভূমি এবং কৃষি সম্পদও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’ বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণের জমি ব্যতীত অন্য সকল প্রকার জমির উপরেই রাজার কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে এবং তিনি সেই জমি থেকে কর পাবারও অধিকারী। ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’ও বলা আছে, রাজা ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগণের কাছ থেকে কর পাবার অধিকারী এবং প্রয়োজনে তাদের নির্যাতনও করতে পারেন। তবে রাজার এই রাজনৈতিক অধিকারের সাথে ভূমির মালিকানার কোন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে কিনা তা ঐতরেয় ব্রাহ্মণের কোন উল্লেখ থেকে সুপষ্টভাবে জানা যায় না। যাইহোক্, পরবর্তীকালে সংহিতা ও ব্রাহ্মণের যুগে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীর যৌথ সম্পত্তিগুলি রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক জমির মালিকানা নিয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করলেও সাধারণভাবে একমত যে, ঋগ্বৈদিক যুগে ভূমির মালিকানা স্বত্ব গোষ্ঠীর হাতেই ছিল। ক্রমে ভূ-সম্পত্তির উপর গোষ্ঠীর মালিকানা বিলুপ্ত হতে থাকে এবং রাজার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। তবে এই প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী, যার শুরু হয় সংহিতা ও ব্রাহ্মণের যুগে এবং সম্পূর্ণ হয় অর্থশাস্ত্রের কালে।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের দ্বিতীয় ভাগে ভারতে জমির মালিকানা-সংক্রান্ত ধারণার প্রসার ঘটে। জমিতে চাষবাস করা ও জমির মালিক হওয়ার পার্থক্য প্রাচীন ভারতীয়রা ভালই বুঝতেন। তাঁরা মালিকানা অর্থাৎ অধিকার বোঝাতে সম্বন্ধবাচক সর্বনাম ‘স্ব’ এবং সাময়িক ভোগদখল বোঝাতে ‘ভুজ’ (ভো করা) ধাতু থেকে উৎপন্ন ‘ভোগ’, ‘ভুক্তি’ ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করতেন। মনুসংহিতায় আবাদী জমিকে ব্যক্তির প্রধান সম্পত্তির মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য করা হয়েছে। মহাভারতের কর আদায় সংক্রান্ত উল্লেখ থেকেই মনে করা হয়, সমসাময়িক কালে ভূমির উপর কৃষকের অধিকারই স্বীকৃত ছিল। তবুও ভূমির মালিকানা-সংক্রান্ত বিষয়টি বিতর্কিতই থেকে যায়, কারণ অন্যান্য বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদান থেকে আরও দুই প্রকার, অর্থাৎ সর্বমোট তিন প্রকার মালিকানার কথা জানা যায়। এই তিন প্রকার মালিকানাগুলি ছিল—
- ব্যক্তিগত মালিকানা,
- সামাজিক বা গোষ্ঠী মালিকানা ও
- রাষ্ট্রীয় মালিকানা।
পূর্বেই বলা হয়েছে, মনুসংহিতা বা মহাভারতের উল্লেখ থেকে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া স্মৃতিশাস্ত্রে ভূমির ব্যক্তি মালিকানা সংক্রান্ত তিনটি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে, এগুলি হল জমি বিক্রয়, দান ও বন্ধক সংক্রান্ত অধিকার। এই তিনটি অধিকার থাকবে এমন কৃষকই জমির প্রকৃত স্বামী। বলা বাহুল্য, প্রাচীন ভারতের ভূমি, বহু ক্ষেত্রেই এই ত্রিবিধ লক্ষণের অধিকারী ছিল। এমনকি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মত রাজতন্ত্র অনুসারী শাস্ত্রেও খাজনার বিনিময়ে জমির ইজারা দেওয়ার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তির মালিকদের মধ্যেও স্তরভেদ ছিল। ধনী ভূস্বামী ছাড়াও ছোট ছোট ভূমির মালিকও ছিল অনেক।
ধনী ভূস্বামীরা তাদের চাষের জমিতে ক্রীতদাস ও খেতমজুর দিয়ে চাষ করাতেন; অপর পক্ষে ক্ষুদ্র জমির অধিকারীরা নিজপরিবারের সাহায্যে চাষ-আবাদ করতেন। তবে সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষিত ও অলঙ্ঘনীয় ছিল। ‘মনুসংহিতায়’ উল্লেখ আছে, একমাত্র জমির মালিকেরই অধিকার আছে জমি সম্বন্ধে যে-কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার, দান করার, অথবা বন্ধক রাখার ইত্যাদি। ‘নারদস্মৃতি’-তে একটি বিধান লিপিবদ্ধ আছে যে, স্বয়ং রাজারও অধিকার নেই ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিকে লঙ্ঘন করার। তবে রাজশক্তি সর্বদাই সম্পত্তির মালিকদের অধিকার খর্ব করার প্রয়াস চালাতো এ প্রমাণ আমরা অর্থশাস্ত্রের উল্লেখ থেকে জানতে পারি। সেখানে বলা হয়েছে, কোন ভূস্বামী যদি জমিতে চাষ করতে ব্যর্থ হন তাহলে রাজা সেই জমি পুনর্গ্রহণ করে অন্য কৃষকের হাতে সমর্পণ করতে পারেন। আবার বৃহস্পতি-স্মৃতির উল্লেখ থেকে রাজার অধিকারের সীমা এতদূর বিস্তৃত ছিল বলে মনে হয় না। সেখানে উল্লিখিত হয়েছে, রাজা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির উপর কর ধার্য করতেন, ভূস্বামী কর না দিলে রাষ্ট্রের তরফ থেকে জরিমানা ধার্য করতেন, কিন্তু কখনই ভূস্বামীদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিতে পারতেন না। যাই হোক, উপরের আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায়, ‘প্রাচীন ভারতে কোন ব্যক্তিবিশেষ ভূসম্পত্তির অধিকারী হতে পারত না,’—ডিওডোরাসের এই উক্তি স্থানীয় মৌলিক সূত্রগুলির সাথে এবং তৎকালীন পরিস্থিতির সাথে খাপ খায় না।
প্রাচীন ভারতে ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানাকে ঐতিহাসিক পাওয়েল স্বীকৃতি দিলেও হপকিন্স এই মতের সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, প্রাচীনকাল থেকেই ভূমিতে সমষ্টিগত মালিকানার রীতি প্রচলিত ছিল। ঋগবেদে গোচারণভূমির সমষ্টিগত মালিকানার কথা বলা আছে। শাক্য রাজতন্ত্রেও সমষ্টিগত উদ্যোগে জমি চাষ করা হত। এমন কি অর্থশাস্ত্রেও গ্রাম্য জমিচাষের জন্য যৌথ খামারের উল্লেখ আছে। সমষ্টিগত মালিকানাধীন ভূমির রাজস্ব সবার কাছ থেকে আদায় করা হত, চাষও করা হত সমষ্টিগতভাবে। এমনকি জরিমানা হলে তাও দেওয়া হত সমষ্টিগতভাবে। অবশ্য ড. অতীন্দ্রনাথ বসুর মতে, মৌর্যযুগ থেকেই ভূমিতে সমষ্টিগত মালিকানা হ্রাস পেয়েছিল এবং কৃষকের ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাজার অধিকার দুই-ই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল।
মৌর্যযুগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভূমি :
দেশের জমিজায়গার একটা বৃহৎ অংশ ছিল রাষ্ট্রীয় জমি ও রাজার খাস দখলভুক্ত জমি। রাষ্ট্রীয় জমি বলতে বোঝাত জঙ্গল, খনি ও পতিত জমি। মৌর্য সম্রাটদের শাসনকার্য পরিচালনা ও সামরিক বাহিনী পালনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। আবার রাজস্বের অন্যান্য উৎসের তুলনায় রাষ্ট্রীয় জমিই ছিল আয়ের নিশ্চিত ও প্রধান উৎস। সে কারণে মৌর্যযুগে বিভিন্ন প্রকারে রাষ্ট্রীয় জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। রাষ্ট্র পতিত জমি উদ্ধার করে তাতে বসতি স্থাপন করলে জমির গ্রহীতারা প্রজাস্বত্ব পেত কিন্তু মালিকানাস্বত্ব রাষ্ট্রের হাতে রাখা হত। সম্ভবত এই কারণেই গৌতম ধর্মসূত্র, স্মৃতিশাস্ত্র, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বা তাঁর টীকাকার ভট্টস্বামীর উল্লেখে রাজাকেই জমির প্রকৃত মালিক বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। রাজার দখলীকৃত জমির অন্তর্ভুক্ত ছিল তাঁর ‘খাস আবাদ’ বা ‘সীতা’। এই সমস্ত জমি রাজা যেমন খুশী বিলি-বন্দোবস্ত করতে পারতেন। খাসদখলের জমিগুলিতে চাষ করত ক্রীতদাস, খেতমজুর ও নানা স্তরের ভাড়াটিয়া কৃষক প্রজারা। অর্থশাস্ত্র অনুসারে প্রাকৃতিক সম্পদ, পতিত ও অকর্ষিত জমির উপর রাষ্ট্রের অধিকার স্বীকৃত ছিল। অর্থশাস্ত্রের ‘জনপদ নিবেশ’ প্রকরণে দু’প্রকার জমির উল্লেখ পাওয়া যায়। একশ্রেণির জমি থেকে উৎপন্ন শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ রাষ্ট্র রাজস্ব হিসেবে গ্রহণ করত, — এই রাজস্বকে ‘ভাগ’ বলা হত। দ্বিতীয় শ্রেণির জমিতে চাষ-আবাদ ও বসতি স্থাপন সবই হত রাজার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এই জমিগুলিকে ‘সীতা’ বলা হত। এই জমিগুলি ছিল রাজার নিজস্ব জমি। সম্ভবত এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেই মেগাস্থিনিস বলেছিলেন, ভারতের সকল ভূসম্পত্তিই ছিল রাজার অধিকারভুক্ত। স্পষ্টতই রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিস রাজধানীতে বাস করায় ভ্রমবশত রাজার খাস দখলের জমির শাসনব্যবস্থাকেই সমগ্র দেশের শাসনব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন। যাই হোক্, প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন লিপি ও আকরগ্রন্থ থেকে নিশ্চিতভাবেই জানা যায়, রাজা রাজস্ব আদায় করতেন দেশের একমাত্র ভূস্বামী হিসেবে নয়; রাজ্যের সর্বসাধারণের রক্ষাকর্তা হিসেবে।
বিভিন্ন ধরনের জমির মালিকানা সম্পর্কে পাওয়া তথ্য থেকে বোঝা যায় কেন ইতিহাসবেত্তারা মালিকানার প্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য নানা পূর্বানুমানের আশ্রয় নিয়েছেন। আকর সূত্রগুলি ইঙ্গিত দেয় প্রাচীন ভারতে নানা ধরনের মালিকানা প্রচলিত ছিল। সর্বোপরি মৌর্য সাম্রাজ্যের মত বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মালিকানার প্রকৃতি সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট উত্তর আশা করা সমীচীন হবে না। ড. উপেন্দ্রনাথ ঘোষালের মতে, মৌর্য আমলে জমির উপর রাজার একচেটিয়া মালিকানা ছিল না। লোভিনও (G. B. Levin) এই মত সমর্থন করেন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।