আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “শশাঙ্কের নেতৃত্বে গৌড়ের উত্থান ও শশাঙ্কের পর বাংলার অবস্থা” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
শশাঙ্কের নেতৃত্বে গৌড়ের উত্থান
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর পরবর্তী গুপ্ত নামধারী রাজাগণ গৌড়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে গৌড় জনপদ গঠিত ছিল। গুপ্তরাজ বৈন্যগুপ্তের মৃত্যুর পর থেকে কনৌজের মৌখরী রাজগণ গৌড় দখলের চেষ্টা করেন। এই কারণে পরবর্তী গুপ্তদের সাথে মৌখরীদের নিরন্তর যুদ্ধ চলে। সেইসঙ্গে চালুক্যবংশীয় রাজাগণও বারবার গুপ্তদের আক্রমণ করতে থাকে। ফলে গুপ্তগণ ক্রমশ হীনবল হয়ে পড়েন। সেই সুযোগে শশাঙ্ক গৌড়ে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন (৬০৬ খ্রিঃ)।
শশাঙ্কের রাজত্বকাল সম্বন্ধে জানার জন্য আমাদের মূলত বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ ও হিউয়েন সাঙ-এর ‘বিবরণ’-এর ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু বাণভট্ট ছিলেন শশাঙ্কের বিরোধী এবং হিউয়েন-সাঙ ছিলেন হর্ষের সাহায্যপ্রাপ্ত। এই কারণে দুজনেরই বিবৃতি পক্ষপাতমূলক ছিল বলে মনে হয়।
শশাঙ্কের বংশপরিচয় বা বাল্যজীবন সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায়নি। শশাঙ্কের কিছু মুদ্রায় ‘নরেন্দ্রগুপ্ত’ বা ‘নরেন্দ্রাদিত্য’ নামটি পাওয়া গেছে। এ থেকে অনেকে মনে করেন, তিনি গুপ্তবংশীয় শাসক ছিলেন। কিন্তু রোহিতাশ্বের (রোটাসগড়) গিরিগাত্রে ‘শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক’ এই নামটি খোদিত আছে। এখানে সম্ভবত গৌড়রাজ শশাঙ্কের কথাই বলা হয়েছে। তা যদি হয়, তাহলে শশাঙ্ক প্রথম জীবনে একজন সামন্ত নরপতি ছিলেন বলা যায়। এখন প্রশ্ন হল: তাঁর প্রভু কে ছিলেন? ড. বি. সি. সেন, ডি.সি. গাঙ্গুলী প্রমুখ মনে করেন যে, শশাঙ্ক মৌখরীদের অধীন সামন্ত নৃপতি ছিলেন। কিন্তু ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে পরবর্তী গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্ত মগধে রাজত্ব করতেন। সুতরাং শশাঙ্ক এঁরই অধীন সামস্ত নৃপতি ছিলেন বলে মনে হয়।
ড. মজুমদারের মতে, “শশাঙ্কই প্রথম বাঙালি রাজা, যিনি আর্যাবর্তে সার্বভৌম শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন।” সামান্য সামন্ত থেকে নিজ বাহুবলে তিনি বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার ‘কর্ণসুবর্ণ। সিংহাসনে বসেই তিনি রাজ্যবিস্তারে উদ্যোগী হন। গৌড়ের অধিপতি হিসেবে উত্তর ও পশ্চিম বাংলার ওপর প্রথম থেকেই তাঁর আধিপত্য ছিল। ‘মেদিনীপুর লেখ’ থেকে জানা যায় যে, দণ্ডভুক্তি অর্থাৎ মেদিনীপুর জেলার ‘দাঁতন’ ও ‘উৎকল’ (বালেশ্বর অঞ্চল) জয় করেন। এই অঞ্চল দুটি তাঁর সামন্তদের দ্বারা শাসিত হত। শশাঙ্কের অষ্টম রাজ্যবর্ষের ‘প্রথম মেদিনীপুর লেখ’ থেকে জানা যায় যে, মহাপ্রতিহার শুভকীর্তি দণ্ডভুক্তি শাসন করতেন। ‘দ্বিতীয় মেদিনীপুর লেখ’ অনুযায়ী উৎকলের শাসক ছিলেন মহাবলাধিকৃতি সোমদত্ত। উড়িষ্যার কোঙ্গদ (গঞ্জাম জেলা) অঞ্চলে রাজত্বকারী শৈলোদ্ভব রাজবংশও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। কারণ এই বংশের রাজা দ্বিতীয় মাধবরাজ শশাঙ্ককে তাঁর অধিরাজ বলে স্বীকার করেছিলেন। সম্ভবত উৎকল ও কোঙ্গদ জয় করার জন্য তাঁকে এই অঞ্চলে স্বাধীনভাবে রাজত্বকারী মান রাজাদের পরাস্ত করতে হয়েছিল। তাম্রফলকে একজন গৌড়রাজের উল্লেখ আছে যিনি কামরূপরাজ ভাস্করবর্মনকে পরাস্ত করেছিলেন। পণ্ডিতগণ মনে করেন যে, এই গৌড়রাজ ছিলেন শশাঙ্কই। মগধও সম্ভবত প্রথম থেকেই তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল।
পূর্ব ভারত বিজয়ের পর শশাঙ্ক পশ্চিম ভারত বিজয়ে অগ্রসর হন। পশ্চিম কনৌজ রাজ্যের মৌখরীরা ছিল গৌড়ের শত্রু। থানেশ্বরের রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজশ্রীর সঙ্গে কনৌজের মৌখরীরাজ গ্রহবর্মনের বিবাহ হবার ফলে উভয় দেশের মধ্যে মৈত্রীজোট গড়ে উঠেছিল। এই অবস্থায় শশাঙ্ক থানেশ্বরের শত্রু মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে পালটা মৈত্রীজোট গঠন করেন। এইভাবে শক্তিসংগ্রহের পর শশাঙ্ক ও দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমণ করে গ্রহবর্মনকে হত্যা করেন এবং রাজ্যশ্রীকে বন্দি করেন। এই সংবাদ পাওয়ামাত্র থানেশ্বররাজ রাজ্যবর্ধন মালব আক্রমণ করে দেবগুপ্তকে হত্যা করেন। কিন্তু কনৌজ উদ্ধার বা রাজ্যশ্রীকে মুক্ত করার আগেই তিনি শশাঙ্কের হাতে নিহত হয়েছিলেন। রাজ্যবর্ধনের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছু বিতর্ক আছে। বাণভট্টের রচনা ও হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ মতে, শশাঙ্ক কাপুরুষের মতো বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেছিলেন। এই কারণে ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থে শশাঙ্ককে ‘গৌড়াধম’ বলে নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু ড. আর.সি. মজুমদার মনে করেন, শশাঙ্কের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষবশত বাণভট্ট বা হিউয়েন সাঙ তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের উদ্দেশ্যে এই বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু আর. জি. বসাক প্রমুখ আধুনিক গবেষকরা মনে করেন, সমকালীন তথ্যের ভিত্তিতে একথা বলা সংগত যে, শশাঙ্ক আকস্মিক আক্রমণ দ্বারাই রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেছিলেন। অবশ্য প্রাচীন রাজনৈতিক ধারার বিচারে তাঁর এই কাজ অস্বাভাবিক বা অনৈতিক ছিল না।
রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন থানেশ্বর ও কনৌজের রাজা হন। তিনি ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ইতিমধ্যে শশাঙ্কের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে কামরূপরাজ ভাস্করবর্মন হর্ষের সাথে যোগ দেন। রাজ্যবর্ধনের দশ হাজার সেনার অবশিষ্টাংশ সেনাপতি ভণ্ডীর অধীনে প্রত্যাগমন করেছিল। পথে হর্যের সাথে দেখা হলে হর্ষ ভণ্ডীর ওপর বাহিনীর ভার দিয়ে প্রথমে রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করেন। তারপর গঙ্গাতীরে ভন্ডীর বাহিনীর সাথে মিলিত হন। এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কোন্ পথে অগ্রসর হয়েছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। বাণভট্ট বা হিউয়েন সাঙ কারোর লেখাতেই শশাঙ্কের সঙ্গে হর্যের যুদ্ধ বা তার ফলাফলের কোনো উল্লেখ নেই। একমাত্র ‘আর্যমঞ্জুশ্রী-মূলকল্পে’ বলা হয়েছে যে, অসাধারণ পরাক্রমশালী তাঁর (রাজ্যবর্ধনের) কনিষ্ঠ ভ্রাতা (হর্ষবর্ধন) বহু সৈন্যসহ বিখ্যাত সোমের (শশাঙ্কের) রাজধানী পুণ্ড্রনগরীর বিরুদ্ধে অভিযান করেন। তিনি দুর্বৃত্ত সোমকে পরাজিত করেন ও স্বীয় রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন।
কিন্তু আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্পের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে পণ্ডিতগণ প্রশ্ন তুলেছেন। ড. মজুমদারের মতে, এই গ্রন্থ ছিল কতকগুলি কিংবদন্তীর সমাবেশ মাত্র। তিনি বলেছেন, “It would be extremely unsafe to accept the statement recorded in this book as historical.” তা ছাড়া পুণ্ড্রনগরী শশাঙ্কের রাজধানী ছিল না, কিংবা হয় ওই নগরীতে কোনো অভিযান করেছিলেন বলে হিউয়েন সাঙ তাঁর বর্ণনায় উল্লেখ করেননি। সুতরাং হর্ষ শশাঙ্কের বিরুদ্ধে তেমন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেননি বলে মনে হয়। কারণ হিউয়েন সাঙের বর্ণনা থেকেই জানা যায় যে, মৃত্যুর সময় পর্যন্ত মগধ শশাঙ্কের অধীনস্থ ছিল। মা-তোয়ান-লীনের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, হর্ষ ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে ‘মগধের রাজা’ উপাধি নেন ও তারপরে উৎকল, কোঙ্গদ জয় করে রাজমহলের কাছে শিবির স্থাপন করেন। কিন্তু হিউয়েন সাঙ-এর বর্ণনা অনুসারে এর আগেই ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দের অনতিকাল পূর্বে বোধিবৃক্ষ ছেদনের মতো পাপকাজের ফলস্বরূপ শশাঙ্ক মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সুতরাং শশাঙ্ক জীবিত থাকাকালীন হর্ষ তাঁর রাজ্য দখল করতে পারেননি। সম্ভবত শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মানবদেবকে পরাজিত করে হর্ষ ও ভাস্করবর্মন বাংলাদেশ ভাগ করে নেন।
শশাঙ্ক ছিলেন শৈব। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তিনি বৌদ্ধদের ওপর নানারকম অত্যাচার করেছিলেন। যেমন—কুশীনগর বিহার থেকে বৌদ্ধগণের বিতাড়ন, পাটলিপুত্রে বুদ্ধের চরণচিহ্ন অঙ্কিত প্রস্তরখণ্ড গঙ্গাজলে নিক্ষেপকরণ, বোধিবৃক্ষ ছেদন ও সর্বশেষে একটি বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের অপচেষ্টা। এইসব কারণে বাণভট্ট তাঁকে ‘গৌড়াধম’, ‘গৌড়ভুজঙ্গ’ইত্যাদি নামে ব্যঙ্গ করেছেন। বাস্তবিকই, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে কোনো রাজার এই ধরনের ধর্মীয় সহনশীলতার অভাব খুবই দুর্লভ ঘটনা। এজন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক এ ধরনের আচরণের সঠিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা মনে করেন যে, হয়তো মগধের বা শশাঙ্কের রাজ্যের অন্য অঞ্চলের বৌদ্ধগণ বৌদ্ধসম্রাট হর্ষবর্ধনের প্রতি এতই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন যে, তারা নিজদেশের রাজার বিরুদ্ধাচরণেও কুণ্ঠিত হত না। এদিকে যেহেতু শশাঙ্কের সঙ্গে হর্ষের দীর্ঘ সংগ্রাম চলেছিল, তাই হর্ষের অনুরাগী নিজের বৌদ্ধ-প্রজাদের প্রতি তিনি সর্বদা সদয় আচরণ করতে পারেননি। তা ছাড়া শশাঙ্কের এই বৌদ্ধ-নির্যাতনের কাহিনি কিছুটা অতিরঞ্জিত বলেও মনে হয়। কারণ হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকেই জানা যায় যে, তিনি তাম্রলিপ্ত ও কর্ণসুবর্ণে বৌদ্ধস্তূপ দেখেছিলেন এবং তখন গৌড়ের বৌদ্ধমঠে বহু বৌদ্ধ নিশ্চিত্তে জীবনযাপন করতেন।
শশাঙ্ক কেবল শক্তিশালী বাংলাই গঠন করেননি, উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে তাকে মর্যাদার আসনেও প্রতিষ্ঠিত করেন। শশাঙ্কের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে পালরাজারা বাংলাকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্য গঠনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাই ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “He (Sasanka) laid the foundation of the imperial fabrick in the shape of realised hopes and ideals on which the Palas built at a later age. ” প্রশাসক হিসেবে শশাঙ্ক স্বতন্ত্র রীতির প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। একেই নীহাররঞ্জন রায় ‘গৌড়তন্ত্র’ আখ্যা দিয়েছেন। শশাঙ্কের সময়েই বাংলার প্রশাসনে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য স্বীকৃতি লাভ করে।
শশাঙ্কের পর বাংলার অবস্থা
শশাঙ্ক স্থাপিত সাম্রাজ্যের ভিতের ওপরই পালবংশীয় রাজারা সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু এই দুই আলোকরেখার মধ্যবর্তীকালে বাংলা ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন। শশাঙ্কের মৃত্যু বাংলার রাজনৈতিক জীবনে যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল, তা পালরাজাদের আগমনকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই সময়ে এদেশে ঘটেছে পুনঃপুন বহিরাক্রমণ। এ সময়ে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ বাংলায় এসেছিলেন। তিনি তখন বাংলাদেশে ৫টি রাজ্যের অস্তিত্ব দেখেছেন। এগুলি হল কজঙ্গল, পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, তাম্রলিপ্ত ও সমতট। ‘আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্পে’ উল্লেখ করা হয়েছে যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় অন্তর্কলহ ও বিদ্রোহে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বাংলার এহেন রাজনৈতিক দৈন্যের ফলেই হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মন বাংলাদেশ আক্রমণ করতে পেরেছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর পদ্মানদীর উত্তরভাগে ভাস্করবর্মনের এবং দক্ষিণভাগে হর্ষবর্ধনের আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল। ড. মজুমদার, কর্ণসুবর্ণ থেকে প্রচারিত ভাষ্করবর্মনের একটি ভূমিদান পট্টকে ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। অবশ্য এ বিষয়ে পণ্ডিতগণ একমত হতে পারেননি।
সম্ভবত গৌড়ে ভাস্করবর্মনের কর্তৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে কর্ণসুবর্ণে জয়নাগ নামে একজন রাজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তিনি মহারাজাধিরাজ উপাধি নিয়েছিলেন। তাই ধারণা করা হয়, জয়নাগ বেশ শক্তি ও কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। অনুমান করা হয় যে, বর্তমান বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলার অন্তর্গত ভূখণ্ড তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
জয়নাগের মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দী কাল বাংলার ইতিহাস খুবই অস্পষ্ট। এই সময়ে তিব্বতীয়দের সহায়তায় চীন পূর্ব ভারতে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। তিব্বতরাজ স্র-সান-গাম্পো সম্ভবত ভাস্কর-বর্মনের উত্তরাধিকারীদের পরাজিত করে বাংলার কিছু অংশে এবং আসামের কিছু অংশে তাঁর কর্তৃত্ব স্থাপনে সক্ষম হন। সমকালীন সাহিত্যে সম্ভবত ‘ম্লেচ্ছ’ বলতে তিব্বতীয়দের বোঝানো হয়েছে।
অষ্টম শতকের প্রারম্ভে শৈলবংশীয় জনৈক রাজা পুণ্ড্র বা উত্তরবঙ্গ জয় করেছিলেন। সম্ভবত ৭২৫ খ্রিস্টাব্দে এই ঘটনা ঘটেছিল। বাংলায় শৈল শাসনের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। এর অল্পকাল পরে কনৌজরাজ যশোবর্মা গৌড় ও বঙ্গ জয় করেন। এই ঘটনাকে অবলম্বন করে বাকপতিরাজ ‘গৌড়বাহ’ (গৌড়বধ) নামে একটি কাব্য রচনা করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তিনি কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্যের কাছে পরাজিত হন। অবশ্য ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে ললিতাদিত্য কর্তৃক গৌড় বিজয়ের কোনো উল্লেখ নেই। তবে কবি কলহন এই গ্রন্থে এমন দুটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যা থেকে মনে করা যেতে পারে যে, গৌড়রাজ ললিতাদিত্যের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। যেমন- (১) গৌড়মণ্ডল থেকে একটি হস্তীবাহিনী কাশ্মীর-রাজের সাথে যোগ দিয়েছিল। (২) ললিতাদিত্যের আক্রমণে গৌড়রাজ কাশ্মীরে গেলে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদে গৌড়ের একদল সেনা ছদ্মবেশে কাশ্মীরে গিয়ে ধ্বংসকার্য শুরু করে। অবশ্য কাশ্মীর-সৈন্যের হাতে তারা সকলেই প্রাণ হারায়। ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে এইসব বীরের আত্মত্যাগের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। কলহনের রচনা থেকে আরও জানা যায় যে, ললিতাদিত্যের পৌত্র জয়াপীড় গৌড়ের সামন্তরাজা জয়ন্তর কন্যাকে বিবাহ করেন ও গৌড়ের ৫ জন নরপতিকে পরাজিত করে জয়ন্তকে সমগ্র গৌড়ের আধিপত্য প্রদান করেন। এ কাহিনির সত্যতা সন্দেহাতীত না-হলেও একথা সত্য যে, তখন গৌড়ে বিচ্ছিন্ন শাসন প্রচলিত ছিল।
নেপালের লিছবীবংশীয় রাজা দ্বিতীয় জয়দেবের শিলালিপিতে তাঁর শ্বশুর রাজা হর্ষ (ভগদত্তবংশীয়) গৌড়সহ বাংলার কিছু অংশ দখল করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে।
বঙ্গরাজ্য অর্থাৎ বর্তমানের ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর অঞ্চল শশাঙ্কের রাজ্যের অন্তর্গত ছিল কিনা বলা যায় না। তবে হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পরেও সেখানে ‘সমতট’ নামে স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। অতঃপর এখানে খড়্গবংশের উত্থান ঘটে। ঢাকার নিকট আসরফপুরে প্রাপ্ত দুটি তাম্রপট্ট ও কুমিল্লার দেউলবাড়িতে প্রাপ্ত একটি মূর্তির সূত্রে এই তথ্য পাওয়া যায়। এঁরা সম্ভবত অষ্টম বা নবম শতকে রাজত্ব করতেন। পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের ওপর খড়্গবংশের শাসন কায়েম ছিল।
কনৌজের যশোবর্মা গৌড় দখল করার পর বঙ্গ জয় করেন বলে অনুমান করা হয়। তবে তাঁর অধিকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে খড়্গবংশের শাসনের অব্যবহিত আগে এই অংশে রাতবংশীয় কিছু রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁরা ‘বামতটেশ্বর’ উপাধি নিয়েছিলেন। কারও কারও ধারণা, রাতবংশ খড়্গবংশের অধীনে সামন্ত ছিলেন এবং পরে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন। ত্রিপুরায় প্রাপ্ত একটি তাম্রশাসন থেকে লোকনাথ ও তাঁর পূর্বপুরুষদের রাজত্বের কথা জানা যায়। অনেকের মতে, লোকনাথ রাতবংশীয় জীবধারণের সামন্ত ছিলেন। শ্রীহট্ট জেলার কালাপুর তাম্রশাসন থেকে জনৈক সামস্ত শ্রীমরুণ্ডনাথের কথা জানা যায়। উল্লিখিত দুটি তাম্রশাসনের সাদৃশ্য থেকে মনে করা হয় যে, এঁরা দুজনে একই ব্যক্তির অধীনে সামন্তরাজা ছিলেন।
তিব্বতীয় লামা তারানাথের ইতিহাস থেকে চন্দ্রবংশীয় কয়েকজন রাজার নাম জানা যায়। এই বংশের শেষ দুজন রাজা ছিলেন গবিচন্দ্র ও ললিতচন্দ্র। সম্ভবত, চন্দ্রবংশীয় রাজারাই খড়গবংশ বা রাতবংশের হাত থেকে বঙ্গ জয় করেন এবং ললিতচন্দ্রকে শেষ পর্যন্ত যশোবর্মা পরাজিত করেন।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।