‘সুচেতনা’ কবিতাটি ইতিহাস চেতনার কবিতা হিসাবে কতখানি সার্থক হয়ে উঠেছে—আলোচনা করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “‘সুচেতনা’ কবিতাটি ইতিহাস চেতনার কবিতা হিসাবে কতখানি সার্থক হয়ে উঠেছে—আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

‘সুচেতনা’ কবিতাটি ইতিহাস চেতনার কবিতা হিসাবে কতখানি সার্থক হয়ে উঠেছে—আলোচনা করো

মনন ঋদ্ধ আবেগ ও ভাবনা জীবনানন্দ দাশের কাব্যে যে ধরনের স্বকীয় উদ্ভাস এনে দিয়েছিল, সেই উদ্ভাস থেকেই এক সুস্থিত ইতিহাস চেতনা কবির কাব্যে নিরবচ্ছিন্ন ও স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়ে গেছে। বেশ কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে কবি নিজেই তার ইতিহাস চেতনার উজ্জ্বল দিকরেখা দিয়ে গেছেন। আসলে অন্তহীন সময়ের পটভূমিতে বহমান মানব সমাজের অগ্রগতির বোধ, পরিপূর্ণতার সহজ অন্বেষা ও শুভ প্রয়াণের ব্যগ্রতায় পৃথিবীর রণ রক্ত কোলাহলের অন্তর্লীন তাড়নার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবনের মধ্যেই জীবনানন্দ তাঁর কাব্যে একধরনের বিবর্তমান ইতিহাস চেতনা সঞ্চারিত করে গেছেন।

লিরিক কবি হিসাবে জীবনানন্দ নিজের অন্তঃপ্রেরণার দাবী স্বীকার করেছেন বহুবার। কিন্তু তারপরও নিজের অন্তঃপ্রেরণার প্রবল ভূমিকা সম্পর্কে কবি জানিয়েছেন, “কিন্তু ভাব প্রতিভাজাত এই অন্তঃপ্রেরণাও সব নয়। তাকে সংস্কারমুক্ত শুদ্ধ প্রবতর্কের ইঙ্গিত শুনতে হবে, এ জিনিস ইতিহাস চেতনায় সুগঠিত হওয়া চাই।” (কবিতা প্রসঙ্গে/কবিতার কথা) একজন কবির কাব্যসৃষ্টির পক্ষে ইতিহাসমনস্কতা খুবই জরুরি একটি বিষয়। জীবনানন্দের নিজের কথাতেই এ প্রসঙ্গের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ‘উত্তর রৈবিক বাঙলা কাব্য’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাঙলা কবিতা’ নামক নিবন্ধ দুটিতে ইতিহাস চেতনার বেশ কিছু ভাবনার সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। জীবনানন্দ মনে করতেন, “কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কাল তিনি।” কারণ কবির মতে সকল কালের সকল কবি শিল্পীকেই স্বকালের সাথে সাথে অতীত ও অগ্রজ কবিদের কালের সমাজ ও সময়ের ইতিবৃত্তকে বহন করে চলতে হয়। “যে সময়ে সে কাল কাটাচ্ছে এবং যেখানে সে কাটায়নি, যে ঐতিহ্যে সে আছে এবং যেখানে সে নেই—এই সকলের কাছেই সে (কবি) ঋণী।” কাব্যের অস্থিমজ্জায় মিশে থাকা এই ইতিহাস চেতনাই কবিকে ক্রান্তদর্শী করে তুলেছিল। কাব্য রচনায় বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই জীবনানন্দ বুঝতে পেরেছিলেন, ব্যক্তি ও উত্তরব্যক্তিক কবি-সত্তাই একজন কবিকে এই জীবনের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে। তাঁর কবিতা ইতিহাস চেতনার এক মাত্রাজ্ঞানের সার্থক সমন্বয়ের ফলেই সৃষ্ট।

প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব মানস-ইতিহাস থাকে। সেই মানস-ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর নানা সাংস্কৃতিক উপকরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও থাকে। তবে জীবনানন্দের বিশিষ্টতা সত্যকে নিরাবরণ করে দেখানোয়। জীবনানন্দই যেন খুলে খুলে দেখালেন পুঁজিবাদী সঙ্কটদীর্ণ জীবনের অনিশ্চয়তাকে। আর সেই অনিশ্চয়তার দোলাচলে জীবন যখন বিপন্ন, তখন সেই বিপন্নতার ভিত্তিতে স্পর্শপ্রবণ মনের অপার বিযুক্তিই যে একমাত্র দায়ী—একথাও জানালেন। পণ্য ও তার বাজার দরের ওঠা-নামার মধ্যেই রয়ে গেছে শ্রমিকের সঙ্গে শ্রমজাত ফসলের বিচ্ছেদ। প্রতিযুগেই মানুষ তার শ্রমের ফসল লক্ষ্মীমানের ঘরে তুলে দিয়েছে। তুলে দিয়েছে লুণ্ঠনকারী চেঙ্গিস-অ্যাটিলাদের বিজয়বাহিনীর হাতে। কবি ঐতিহাসিক নিয়তির মতো এই অতীত ও তার পরম্পরায় বাহিত বর্তমানকে দেখেছেন। দেখেছেন সোনা বা মূল্যবান পণ্য হয়ে উঠেছে ‘মানুষের শব’। সভ্যতা আসলে সেই সামাজিক উদ্বৃত্তকরণ যা স্থাপত্যের সারি আর কামান-বন্ধুকের পণ্যবাহী জাহাজে পরিণত। রণ-রক্ত-সফলতাই তাই সভ্যতার ভিত। আর এই সফলতাকে আশ্রয় করেই কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে। এই জয়ের উল্লাস, জনতার জয়ধ্বনি ও আর্তনাদের বিপরীতে সভ্যতা সতত নিষ্ঠুরভাবে বিধৃত। সুচেতনা তাই সর্বতো অর্থে বনলতা সেনের মতো প্রতীকী নারী নয়, উপলব্ধিগত সত্য অনুধাবনের ক্ষমতাও। মানুষের চেতনার জগতে যার অবস্থান দূরতর দ্বীপের মতো। সেখান থেকে এই সভ্যতাকে বদলে দেবার জন্য বহু শতাব্দী ধরে মনীষীরা কাজ করে গেছেন। ইন্দ্রিয়ময় নিসর্গের এই দাক্ষিণ্য, অন্যদিকে যা হল হবে ‘মানুষের যা হবার নয়’ আত্মক্ষয়ী অন্ধকার রাত্রির কাছে এই শাশ্বত সকালের অনন্ত সূর্যোদয়ের অভিজ্ঞতাই শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দকে ইতিহাসের রূপকার করে দিয়েছে।

‘বনলতা সেন’ কাব্যে জীবনানন্দের কবিতাগুলি গভীর ভাবেই প্রতীকাশ্রিত। ‘সুচেতনা’ কবিতাটিও ইতিহাস চেতনায় নিষিক্ত হয়ে, প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সু-চৈতন্যের উদ্বোধন ঘোষণা করে। এই সুচৈতন্য ইতিহাসবেদেরই দান। কবি মানসে আবেগ ও প্রজ্ঞার মিলন ঘটিয়ে সে চেতনা মানব সভ্যতার শুভ ও কল্যাণবহ সম্পদগুলিকে চিনে নিতে সাহায্য করে। রণ রক্ত-সফলতার কোলাহলে আলোকিত ইতিহাসের ঘনঘটা যে মানবের ইতিহাসের শেষ কথা নয়, কবি তা জানেন। এই রক্তাক্ত কাজের আহ্বান, মারণ প্রবণতা আর অসার স্বর্ণলিপ্সার গ্লানি বুদ্ধ-কনফুশিয়াসের মতো সাধকদের প্রাণ হয়তো বিমূঢ় করে দিয়েছে বারবার। তবু এই সংঘর্ষ, মৃত্যু আর অন্তহীন অন্বেষার পথেই আছে মুক্তি।

“এই পথে আলো জ্বেলে—এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে, 

সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ

•••••••••••••

গড়ে দেব আজ নয় ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।”

ইতিহাস চেতনার এর চেয়ে কাব্যসুষমাময় উচ্চারণ জীবনানন্দের নিজের কাব্যে অন্য কোথাও, এমনকি সমগ্র বাংলা কাব্যেও দুর্লভ। একটি সুস্থিত ইতিহাস-চেতনার অনেকগুলি দিকই এখানে শৈল্পিক তৃপ্তির কিছুমাত্র ব্যাঘাত না ঘটিয়েই উচ্চারিত হয়েছে। ‘ক্রমমুক্তি’ এবং ‘অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’ শব্দ প্রয়োগগুলি লক্ষণীয়। মানবচৈতন্য বিস্তারে মনীষীদের যে অবদান, তার জন্যেই সভ্যতার ইতিহাসে তাঁদের ভূমিকা তাৎপর্যমণ্ডিত।

অতীত সমাজের সঠিক অনুধাবনের ফলে, বর্তমান সমাজের শক্তিগুলির যথাযথ বিচার ও নিয়ন্ত্রণ—এই দ্বিবিধ দায়িত্বই ইতিহাস চর্চার দায়িত্ব। কোনো বিশেষ যুগের চিন্তা ও কর্মনায়কেরা সেইসব সমাজকে শক্তির উদ্বর্তনে সাহায্য করেন তাদের ভাবনা ও কর্মের মধ্য দিয়ে, যেগুলি পৃথিবীর স্থায়ী চিত্রটিকে বারেবারেই বদলে দেয়। ইতিহাসের শক্তিগুলি যে মানবসভ্যতাকে নিয়ে চলেছে তা নিরন্তর পরিবর্তন সাধনের মধ্য দিয়েই। ইতিহাস যে কোনো আকস্মিক ও প্রক্ষিপ্ত পরিবর্তনের বিস্ফোরণ ঘটায় না, শিল্প-সৌকর্যের সেই লেশতম ব্যতয় কবিতাটির মধ্যে কোথাও দেখাননি জীবনানন্দ। এখানেই তিনি স্বনির্দিষ্ট নিরীখের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আবেগ ও প্রজ্ঞার নিটোল সুরসাম্যে ‘সুচেতনা’ কবির ইতিহাস ভাবনার একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম।

আসলে সমাজকে না বুঝতে পারা যেমন বিযুক্তির সৃষ্টি করে, সমাজকে ঠিকঠাক জানাও জন্ম দেয় আরও বড়ো রকমের বিযুক্তিকে। প্রথমটি মানুষকে অনিশ্চয়তার যন্ত্রণা দিলে দ্বিতীয়টি দেয় অক্ষম ও অসহায়তার বোধ। প্রেম, জীবন ধারণের নিত্যকর্মগুলিও তখন অর্থহীন হয়ে যায়। জীবনের এই বোধটিকে এড়ানো যায় না কখনও। মানুষের সঙ্গে এই বোধ একাত্ম। কবির ভাষায়, ‘আমি চলি সেও চলে সাথে। দেহের সীমা পেরিয়ে মনের প্রান্ত ছুঁয়ে ঘুরে ঘুরে একা কথা বলে।

এই ‘বোধ’ নিয়েই জীবনানন্দের ইতিহাস চেতনা। সমস্ত মৃত নক্ষত্রকে, অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিল পুরুষের শিশির ভেজা চোখের মতো’ প্রাণিত ও প্রাণহীনতার পরপারে জীবজগতের বিন্দুতে ধারণ করেন তিনি। আকাশ তাঁকে শতাব্দীর পর শতাব্দী, কোটি কোটি বছর জুড়ে নতুন নক্ষত্র জন্মের ও মৃত নক্ষত্রের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। স্মৃতি প্রত্যাবর্তনের নীল অত্যাচার, অতীত ও বর্তমানকে আকাশ ও মাটির বিযুক্তির সঙ্গে একীভূত করে রেখেছে। জীবনানন্দ সেই কঠিন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়ে বিশ্ব ইতিহাসের সঙ্কটদীর্ণ পৃথিবী ও স্বদেশকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন। সুচেতনা কবিতাটিও এ ভাবনার ব্যতিক্রম নয়।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment