বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং কমলাকান্তের দপ্তরকে তাঁহার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। কমলাকান্তের দপ্তর সম্পর্কে বঙ্কিমের এই অভিমতের যৌক্তিকতা বিচার করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং কমলাকান্তের দপ্তরকে তাঁহার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। কমলাকান্তের দপ্তর সম্পর্কে বঙ্কিমের এই অভিমতের যৌক্তিকতা বিচার করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং কমলাকান্তের দপ্তরকে তাঁহার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। কমলাকান্তের দপ্তর সম্পর্কে বঙ্কিমের এই অভিমতের যৌক্তিকতা বিচার করো

বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং কমলাকান্তের দপ্তরকে তাঁহার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলিয়াছেন। পাঠক যখন কমলাকান্তের দপ্তর পাঠ করিবেন তখন স্বতঃই বঙ্কিমের এই মন্তব্য বিচার করিবার ইচ্ছা তাঁহার মনে জাগিবে। বঙ্কিম যে অর্থে কমলাকান্তের দপ্তরের শ্রেষ্ঠত্ব মনে করুন না কেন, পাঠকেরও একটা বিশিষ্ট দৃষ্টিকোণ রহিয়াছে। সেই বিশিষ্ট দৃষ্টিকোণটিকে আমরা অস্বীকার করিতে পারিব না।

কমলাকান্তের দপ্তরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করিবার পূর্বে আমাদের জানিয়া রাখিতে হইবে, বঙ্কিমের যাবতীয় রচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিচারের ভূমিকা রচিত হইবে। বঙ্কিম ১৮৬৫ খৃস্টাব্দে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস রচনা করিয়া বাঙালি সাহিত্যের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। পরবর্তীকালে শুধু উপন্যাস নয়, রসরচনা, প্রবন্ধ, ধর্মতত্ত্ব এবং বিজ্ঞান দর্শনের আলোচনা করিয়া বস্কিম সাহিত্য-সরস্বতীর বন্দনা সমাপ্ত করেন।

সাহিত্যের সংজ্ঞা সম্বন্ধে বঙ্কিমের একটি বিশিষ্ট ধারণা ছিল। তিনি মনে করিতেন, সাহিত্য শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হইতেছে যাহা হিত সাধন করে। শুধু আনন্দ বিতরণই সাহিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, শিক্ষা বিতরণের একটি পরোক্ষ কর্তব্য তাহার রহিয়াছে। বঙ্কিম সাহিত্যের এই শিক্ষাগত দিকটা বিশেষভাবে চিন্তা করিয়াছেন। তাছাড়া, বঙ্কিম যখন সাহিত্যের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন তখন বাঙলা দেশে নবীন ইউরোপের নবজাগরণের পবিত্র মন্ত্রধ্বনি পরিব্যাপ্ত হইয়াছে। ইহাতে বাঙালি আপন স্বভাব ধর্ম আদর্শ পরিত্যাগ করিয়া নবীন ইউরোপের নব আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া উচ্ছল মনোবিলাসের জোয়ারে ভাসিয়া চলিয়াছিল; তাহার একটি সুষ্ঠু পথ নির্দেশ দিবার উদ্দেশ্যেও বঙ্কিম-সাহিত্যের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। বঙ্কিমের যাবতীয় রচনায় এই উদ্দেশ্যে নিহিত। ইহাকে লঙ্ঘন করিলে চলিবে না। মোট কথা বঙ্কিমমানসে একটি নীতির তিক্ত বটিকা রসসিক্ত হইয়া সুখসেব্য হইয়াছে কিনা, তাহাতে শিল্পরূপ অব্যাহত আছে কিনা দেখিতে হইবে। যথার্থ শিল্প হইতে গেলে, তাহার গঠনশৈলী, প্রকাশ কৌশলকেও অবহেলা করা চলিবে না।

উপন্যাসই বঙ্কিমের সর্বপ্রথম সাহিত্যানুশীলন। সেই উপন্যাস যদি এক এক করিয়া আলোচনা করা যায়, তবে দেখা যাইবে বঙ্কিমের যাবতীয় উপন্যাস সার্থক শিল্পকলায় ভূষিত হইবার অবকাশ পায় নাই, কোন উপন্যাসে রোমান্সের বাড়াবাড়ি, কোনটাতে দেশপ্রেমের অবাস্তব ভূমিকা পত্তন, আবার কোনটিতে নীতির অত্যধিক আরোপ। যদিও নীতি-প্রচার বঙ্কিমের অধিকাংশ উপন্যাসের মূল বিষয় তবুও সেই ঐক্য সম্পাদনে বঙ্কিম সমাজের বিচিত্র প্রতিচ্ছবির মাধ্যমে বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্টি করিয়া তাঁহার প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন। বঙ্কিম-প্রতিভা বিধৃত রহিয়াছে রাজসিংহ, কপালকুণ্ডলা, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল প্রভৃতি গ্রন্থে। একটা কথা মনে রাখিতে হইবে, বঙ্কিম-প্রতিভার নানা দিক রহিয়াছে। তাঁহার উপন্যাসে সেই দিকদর্শনের সম্যক প্রকাশ ঘটে নাই। সেই দিকগুলি লজ্জারুণ চাহনি মেলিয়া মুহূর্তেই আত্মগোপন করিয়াছে। বঙ্কিমের উপন্যাসগুলি পাঠ করিয়া মনে হয়, তিনি ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষ পাঠ ছন। কিন্তু সেই পাঠানুশীলনের সামগ্রিক প্রকাশ তাঁহার উপন্যাসে অর্ধাবগুন্ঠিতাকাশে প্রকাশিত। ইতিহাসবেত্তা, ধর্মবিদ, দার্শনিক বঙ্কিমের অন্তরালে এক নির্মল শুভ্র হাস্যরসিক বঙ্কিম অবস্থান করিতেন। সেই হাস্যরসিক বঙ্কিমের প্রকাশ উপন্যাসে প্রসঙ্গক্রমে আসিয়াছে মাত্র, অতএব বঙ্কিম মানসের সামগ্রিক প্রকাশ জানিতে গেলে আমাদের আরও অপেক্ষা করিতে হয়। এইবার তাঁহার প্রবন্ধ-সাহিত্যের আলোচনা করিতে চেষ্টা করা যাক।

ঔপন্যাসিক বঙ্কিমের পরিচয় বাঙালি পাঠক জানেন। বস্তুত উপন্যাসের মাধ্যমে বঙ্কিম তাঁহার মতবাদ, দর্শনের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠার দ্বারা উপন্যাসের রূপ ও রীতি অনেকাংশে হইয়াছে। যাই হোক প্রাবন্ধিক বঙ্কিম উপন্যাস রচনার দায়িত্ব হইতে মুক্ত হইয়া ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, সমাজ নীতির প্রচারে নিজের অভিজ্ঞতার বিস্তৃত পরিধি উন্মোচিত করিলেন। উপন্যাস রচনা করিলে কল্পনার প্রসার চাই, ঘটনার অগ্রসরতা চাই যাহাতে নীতি প্রচারকের পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা। প্রাবন্ধিক বঙ্কিম এই রকম বাধা কাটাইয়া উঠিলেন। তাঁহার ‘বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বঙ্কিম দেশ গঠন ও বাঙালির মানসিক উন্নতির দিকে মন দিলেন। ‘বিবিধ প্রবন্ধ’, ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘কৃষ্ণ চরিত্র’ প্রভৃতিতে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমের সুস্পষ্ট পরিচয় মিলে। বঙ্কিম প্রবন্ধ রচনায় উন্নত রীতির প্রতিষ্ঠা করিলেন। কিন্তু প্রাবন্ধিক বঙ্কিমের আংশিক পরিচয় প্রবন্ধে ধরা পড়ে। প্রাবন্ধিক বঙ্কিম অনেকখানি চাপা, তাঁহার সহানুভূতিশীল রসিক হৃদয়ের উজ্জ্বল আকাশ অনেকখানি অপ্রকাশের অন্ধকারে আবৃত। বঙ্কিম সাহিত্য, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতির আলোচনা করিয়া আত্মবিস্মৃত বাঙালিকে বাঁচিবার উন্নত মানসিকতার অধিবার হইবার মহান আদর্শ স্থাপন করিলেন। কিন্তু বঙ্কিমের সর্বাবয়ব প্রকৃতি তাহাতেও বিকশিত হয় নাই। আমরা যদি কমলাকান্তের দপ্তর পাঠ করি, তবে দেখিব, বঙ্কিম কি নিপুণ কৌশলে, অভিনব শিল্পচেতনায় হাস্যরসের অমৃত মধুর স্রোতে আপন বক্তব্য উপস্থাপিত করিয়াছেন। এই ‘কমলাকান্তের দপ্তরে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নীতি প্রচারক শিক্ষক এবং সর্বোপরি হাস্যরসিক বঙ্কিমের বিস্তৃত হৃদয়ের প্রতিটি গোপন পৃষ্ঠা দৃষ্টিগোচর হয়। মোট কথা ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ বঙ্কিম মানসের বৃহৎ দর্পণ। এই দর্পণে তাকাইলে আমরা বঙ্কিমকে চিনিয়া লইতে পারি।

বঙ্কিম জীবনশিল্পী। মনুষ্য-প্রেম তাঁহার জীবনের একমাত্র সাধ্যবস্তু। জীবনকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করেন বলিয়া জীবনে অসঙ্গতি দেখিলে তিনি গভীর ভাবে বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই বিক্ষোভ প্রকাশ করাই বঙ্কিমের সর্বাতিশয়ী আকাঙ্ক্ষা। শুধু বিক্ষোভ প্রকাশ করাতেই তাঁহার সাহিত্যিক পরিণতি নয়, উপযুক্ত সমাধানের সঠিক পথের নির্দেশও তিনি পাঠককে দেখাইয়াছেন। সমস্যা এবং সমাধানের কথা আছে বঙ্কিমের উপন্যাসে এবং প্রবন্ধে। কিন্তু ইঁহার একত্র সমাবেশ কমলাকান্তের দপ্তরে বিদ্যমান।

বঙ্কিম অসমাপ্ত কর্তব্যের সুষ্ঠু সম্পাদনের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন কমলাকান্ত নামক এমন এক চরিত্র, যে জগৎ এবং জীবন সম্বন্ধে গভীরভাবে অভিজ্ঞ। এই অভিজ্ঞতাই তাহাকে উদাসীন নির্বিকার করিয়া তুলিয়াছে। জীবনের কাছে তাহার আর কিছুই চাহিবার নাই, কিন্তু অনেক কিছুই দিবার আছে। কমলাকান্ত তাই আফিমের নেশার ঘোরে যে সমস্ত কথা বলিয়াছে, তাহা সমস্তই প্রয়োজনীয় এবং অনুশীলনের বিষয়। এই প্রয়োজন এবং অনুশীলনের কথা কমলাকান্ত বলিয়াছে অতি মনোরম ভঙ্গীতে অপূর্ব কৌশলে। অনেকে কমলাকান্তের দপ্তরকে ডিকেন্সের ‘পিকউইক পেপারস’ এবং ডিকুইন্‌সির ‘কনফেসান্‌স্ অব্ এ্যান অপিয়াম্ ইটার’-এর অনুকরণ এবং অনুসরণ বলিয়া বঙ্কিমের মৌলিকত্বের প্রতি কটাক্ষপাত করিয়াছেন। অনুসরণ যাহাই হোক না কেন পাঠক হিসাবে, আমাদের মস্ত বড়ো লাভ যে কমলাকান্তের দপ্তরের মতো একখানি অপূর্ব গ্রন্থ পাইয়াছি বঙ্কিমের হাত দিয়া। আর কিছুর জন্য না হোক, অন্তত কমলাকান্তের দপ্তরের জন্য বঙ্কিম বাঙলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন।

বলিতে দ্বিধা নাই ; কমলাকান্তের দপ্তর সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত গ্রন্থ নয়। পুনরুক্তি, অত্যধিক বিদ্রূপ, অতিকথন দোষে কমলাকান্তের দপ্তর দুষ্ট হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহা বিশেষ লক্ষণীয় নয়।

কমলাকান্ত বাঙালা সাহিত্যে স্থায়ী প্রভাব ফেলিতে পারিয়াছে। পরবর্তী কালের বাঙলা সাহিত্যে কমলাকান্তের মতো উদাসীন নির্বিকারে, নিরভিমান পণ্ডিত ও অপাতঅজ্ঞ চরিত্র সৃষ্ট হইয়াছে। সেই সমস্ত চরিত্রের যা উদ্দেশ্য, কমলাকান্তের উদ্দেশ্যের সঙ্গে তাহাদের অঙ্গাঙ্গী মিল লক্ষ্য করা যায়।

ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ভাবরাজ্যের সুরগ্রামের উচ্চনীচ পর্দা ও তাহাদের মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম মীড়মূৰ্চ্ছনার উপর লোকের সমান অধিকার—’কমলাকান্তের দপ্তর’ একটি তাললয়শুদ্ধ সঙ্গীতের মতো আমাদের রসবোধকে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দান করে। তৃপ্তিদান করে বলিয়া বঙ্কিমের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ শুধু বঙ্কিমের কাছেই নয়, সকল পাঠকের কাছেই তাঁহার শ্রেষ্ঠ রচনা।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment