আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটি নিছক ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ নয়, নাগরিক জটিলতা অবক্ষয়িত মূল্যবোধের প্রতীকী বিন্যাস—মন্তব্যটি আলোচনা করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ’ কবিতাটি নিছক ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ নয়, নাগরিক জটিলতা অবক্ষয়িত মূল্যবোধের প্রতীকী বিন্যাস—মন্তব্যটি আলোচনা করো
ব্যক্তিগত কবিতা রচনার নিবিড় রহস্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কখনই আপ্লুত করেনি, অথচ আশ্চর্যের বিষয় তাঁর কবিতার প্রধান সার্থকতা ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বরের কারণেই। যে মুহূর্তে তাঁর কবিত্বের ধারা অন্য কারো কাছে অনুকরণীয় হতে গেছে তখনই ধরা পড়ে গেছে কবির নিজস্ব স্বরগ্রামের ওঠানামা। এক অসাধারণ ক্ষমতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতাকে গণকণ্ঠে সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছেন। বাংলা কাব্যের প্রসঙ্গ ও প্রকরণের নতুন ধারা সংযোজন এবং অবয়বের নতুন পথ নির্দেশে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা হয়ে উঠেছে একান্তই বিশিষ্ট স্থানলাভের অধিকারী।
ইতিহাসের সন্ধিলগ্নে দাঁড়িয়ে যে-কোনো বড়ো মাপের আদর্শনিষ্ঠ সাহিত্যের মৌল চিন্তাগুলির অনুসন্ধান করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষত জাতীয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যখন প্রবল পালাবদল সংঘটিত হয়ে চলেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, দার্শনিক-নৈতিক মূল্যবোধের যাবতীয় প্রেক্ষিত জুড়েই মানুষের অস্তিত্বগত প্রবল সংকট দীর্ঘায়িত হয়ে চলেছিল সেদিন। পরিদৃশ্যমান এইসব সংকটের প্রাত্যহিক প্রত্যক্ষতা দিয়েই সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার কবিতাকে গড়ে পিটে নিয়েছেন। তবে কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর স্বর পরিশীলিত-অনুচ্চ এবং অবশ্যই উগ্রতাহীন। শিল্পের সরলীকরণ তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায় না। কারণ রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনের যে জটিল অবক্ষয় বিশ্লেষিত হয়েছে তাঁর কবিতায় লেখায় তার কোনো সরলীকৃত প্রকাশভঙ্গি হয় না। সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁর কবিতার একটা বড়ো দিক। এ দায়বদ্ধতাই সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের স্বশ্রেণিভুক্ত করে দিয়েছে কবিকে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ নামকরণেই সামাজিক দায়বদ্ধতার এই প্রকাশ ফুটে ওঠে। আসলে নিজের শ্রেণিগত অবস্থানটিকে ভুলে পথচারী হত দরিদ্র মানুষের মতোই তিনি ক্রমশ বিমর্ষ হতে হতে, ক্ষুব্ধ হতে হতে বাঁচতে এবং লড়তে চান। সেই কারণেই তিনি পদাতিক।
কিন্তু আরও এক ধরনের কবিতা লিখেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সেগুলির বিষয়বস্তুতে রাজনৈতিক চেতনা অতখানি প্রবল না হলেও কবিতাগুলিতে আত্মবীক্ষণের উজ্জ্বল নিদর্শন পাওয়া যায়। এ পর্যায়ের কবিতাগুলিতে আঙ্গিকসচেতন নাগরিক বাকভঙ্গির তীর্যকতা বা ব্যঙ্গপ্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই ব্যঙ্গাত্মক আত্মবীক্ষন জগতের নিবিড় পরিচয় বা বীক্ষারই নামান্তর। ব্যঙ্গাত্মক এই অন্তর্গামী দৃষ্টি নির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদে পাঠকের মননকে বিদ্ধ করেছে একথা বলা যায়। অবশ্য ‘পদাতিকে’ গ্রামজীবনের নিবিড় পদচিহ্ন যে নেই এমন কথা বলা যাবে না। তিরিশের দশকের আধুনিক বাংলা কবিতার নাগরিক জটিলতার প্রতীকগুলিকে তীব্রভাবে উপস্থাপিত করবার জন্যেই কবি গ্রামের প্রত্যয়ী জীবনের প্রতিষেধক তুলে এনেছেন। ‘পদাতিকে’র কবি আসলে দেখাতে চেয়েছিলেন নাগরিক জীবনেও ধনতন্ত্রের সংকটলগ্নের বিষণ্ণ, অস্থির, সংশয়পূর্ণ বিপদগামী এক স্রোত প্রবাহিত হয়ে চলেছে। দিনের শেষে ব্যর্থ, অসার মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত কেরানির ফিরে আসার সঙ্গেই যেন এ কবিতার যথার্থ মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আসলে নাগরিক কণ্ঠস্বর, ছোটো ছোটো বাক বিন্যাস রীতি, ক্রিয়াপদহীন তীব্র গতিশীলতা, কথ্যরীতির প্রখর স্রোেত এক ধরনের বিশেষ সামাজিক রাষ্ট্রিক অবস্থানের দিক নির্দেশক হয়ে এসেছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়। পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বদল ঘটে গেছে বলেই এত সংক্ষেপিত উচ্চারণ মানুষের কথায়। আবার উচ্চারণ সংক্ষেপিত বলেই পরিবর্তিত পটভূমির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবার প্রয়োজনে তা অসম্ভব দ্রুত। দ্রুত পরিবর্তনশীল এই পথচলায় ক্লান্তির সুর কখনও ফোটেনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়।
তবু ব্যঙ্গপ্রবণতা বা তীর্যক বাক বিন্যাসরীতি তিরিশের দশকের কবিদের একটি অন্যতম চরিত্র বৈশিষ্ট্য। মধ্যবিত্ত নাগরিক মানুষের অসংখ্য করুণ সীমাবদ্ধতা ও তার হাস্যকর উন্মোচনে এই ব্যঙ্গের সৃষ্টি। বুদ্ধদেব বসুর কবিতার ক্ষেত্রে এই ব্যঙ্গ সমাজ রাষ্ট্রের সম্মিলিত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, আবার বিষ্ণু দে-র ক্ষেত্রে যুগগত ক্লান্তি বা অসুস্থ অস্থির সময়ের বিরুদ্ধে সভ্যতার উচ্চশিক্ষিত অথচ আপাত প্রতিষ্ঠাহীন প্রজন্মের প্রতিই নিক্ষিপ্ত সে ব্যঙ্গবান। অবিস্মরণীয় কটাক্ষে তিনি উচ্চারণ করেন,
“পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একী সন্ন্যাসী
বিশ্বময় চলেছে তার ভোজ!
মরমিয়া সুগন্ধ তার বাতাসে ওঠে নিঃশ্বাসি,
সুরেশ শুধু খায় দেখি গ্লুকোজ!”
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গ সেক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন সামাজিক রাজনৈতিক ব্যঙ্গ। মধ্যবিত্ত জীবনের বিচ্ছিন্নতার শিকার যেসব বেকার যুবক তাদের প্রতি এই ব্যঙ্গ অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ভাষ্য হয়ে উঠেছে। বেকারত্বের যন্ত্রণায় শীর্ণ যুবকের স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের মূঢ় অসঙ্গতির অসাধারণ ছবি এঁকেছেন কবি রোমান্টিক কবিতায়,
“ঘড়ির কাঁটায় কত যে মিনিট মরছে,
মনে অনন্ত সময়ের অধিরাজ্য ;
ভুলেছি, জ্যোৎস্না হারিয়ে হরিধান্য,
এখানে বন্দী আনা তিনেকের বালবে।”
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দারুণ আঘাতে, দুর্ভিক্ষের কালো শকুনির ছায়ায়, নাগরিক অবক্ষয়ের পাশে অতীত গ্রামজীবনের নিরবচ্ছিন্ন আনন্দও সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল। ‘পদাতিকের’ ‘বধূ’ কবিতাটি তার ব্যতিক্রম নয়।
‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বধূ’ কবিতাটির নামকরণে নির্মল গ্রামজীবনের উদার অনুষঙ্গ থাকলেও, কবিতাটির প্রায় প্রতিটি ছত্রই পাঠককে মনে করিয়ে দেয় নাগরিকতার উন্মত্ত আবিলতাকে। কবিতাটির আসলে এক নাগরিক বধূরই গল্প। সন্ধ্যা সমাগমের প্রাণময় একটি প্রেক্ষিত কবিতাটিতে আসলেও ঠিক তার পিছন পিছন চলে আসে শহর কলকাতার সরুগলি, বেতারের মায়াবী সুর, বিকেলের ঘরে ফেরা ফেরিওয়ালাদের ক্লান্ত হাঁক। রাজপথে তখন জ্বলতে শুরু করেছে গ্যাসের আলো। কর্পোরেশনের কলে জল এসেছে। নাগরিক বধূটি চলেছে কলসী কাঁখে জল আনতে। দিনশেষের শেষ আলোটুকু তখনও নিভে যায়নি আকাশ থেকে। কবি লিখেছেন,
“গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এলো
পুরানো সুর ফেরিওলার ডাকে।
দূরে বেতার বিছায় কোন মায়া
গ্যাসের আলো জ্বালা এদিন শেষে ।”
এরপরই গৃহবধূটির নিজস্ব উচ্চারণ আঙ্গিকে কবি আমাদের শুনিয়েছেন তার জীবন যাপনের কথা। যে জীবন গ্রাম থেকে সদ্য শহরে আসা একটি মেয়ের কাছে প্রবল অথচ করুণ। এক আশ্চর্য আত্মিক উচ্চারণে কবি মেয়েটিকে পরিচিত করিয়েছেন নাগরিক জীবনের সীমাবদ্ধ সঙ্কীর্ণতায়। তীর্যক বাগ্বিন্যাসের নৈপুণ্যে পাঠককে বুঝিয়ে দিয়েছেন গ্রাম ছেড়ে শহরে প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া আপামর মানুষের স্বপ্ন আসলে এক নিদারুণ ছলনা –
“কাছেই পথে জলের কলে, সখা
কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে
হঠাৎ গ্রাম হৃদয়ে দিল হানা
পড়ল মনে, খাসা জীবন সেথা।”
বিবাহ পরবর্তী জীবনে গ্রাম্য মেয়েটি গ্রামের সেই ‘খাসা জীবন’ ছেড়ে শহরে এসেছে। কবির বাবিন্যাস রীতি আমাদের মনে আনে, কলসী কাঁখে বধূটি জল আনতে চললেও তার সামনে কোনো পুকুর বা নদী নেই। শহরে সন্ধ্যা হয়, কিন্তু প্রদীপ জ্বালা কোনো তুলসী তলার দেখা মেলে না। তার পরিবর্তে গ্যাসের আলোয় আলোকিত রাজপথ জেগে ওঠে। সংকীর্তনের সম্মিলিত জীবন সংগীত এ শহরে বেজে ওঠে না, বদলে গলির মোড়ে মোড়ে ফেরিওলার ক্লান্ত সুরে ঘরে ফেরার ডাক শোনা যায়। শহরের এই ক্লান্ত সন্ধ্যার নেমে আসা দেখতে দেখতে বেঁচে থাকার রসদটি খুঁজে পায় না বধূটি। আশৈশব প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠা মেয়েটি তাই শুনিয়ে চলে গ্রাম-জীবনের স্মৃতি ভারাতুর দিনগুলির কথা। মায়াময় মধ্যাহ্নে দীঘির গহীন কালো জলে দুপাশের শ্যামল বনপ্রান্তের নিবিড় ছায়ার খেলা মনে পড়ে মেয়েটির। সেই সঙ্গে মাছ ধরার মতো প্রিয় একটি অনুষঙ্গ উঠে আসে তার স্মৃতিচারণায়,
সারা দুপুর দীঘির কালো জলে
গভীর বন দুধারে ফেলে ছায়া
ছিপে সে-ছায়া মাথায় কর যদি
পেতেও পার কাৎলা মাছ, প্রিয়।
কবি আসলে নাগরিক জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার নিরন্তর প্রাণান্তকর লড়াইয়ের পাশে গ্রামের সরলতামাখা নিশ্চিন্ত জীবনের বৈপরীত্যটিকে দেখাতে চেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে জানিয়েছিলেন, জীবনের রসদ কত সহজে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে। জটিলতাময় নাগরিক বাণিজ্য বৃত্তি জীবন ও জীবিকাকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে বলেই শহরের মানুষ এত ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা নিয়ে বাঁচে। বেঁচে থাকা নাগরিক জীবনের সাধ নয় প্রয়াস হয়ে যায় ক্রমশই।
প্রিয়জ্ঞানে যে মানুষটিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিল মেয়েটি, ভেবেছিল শহর তাকে নিশ্চিন্ত জীবনের আশ্বাস দেবে সেই জীবনে পৌঁছেই মেয়েটি বুঝেছিল এর চেয়ে অনেক বেশি প্রাণময় ছিল তার অতীত জীবন। গ্রামজীবনে বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদটি কীভাবে সংগ্রহ হতে পারে সেই পথটিও বধূটি তার প্রিয়কে দেখিয়ে দিয়েছে। জানিয়েছে গেরুয়া বসনে তারা যদি নিজেদেরকে আড়াল করে বাঁধানো পুকুর ঘাটের উদারতায় শুধু বসেও থাকে, তাহলেও গ্রাম্য মানুষ ভক্ত প্রাণের স্বাভাবিক সরলতায় প্রণামীটুকু দিয়ে যাবে। তাদের সেই উন্মুক্ত জীবন-যাপন অন্তত শহরে কানাগলির হাঁপিয়ে ওঠা জীবন-যাপনের তুলনায় অনেক ভালো। সে জীবনের প্রতিটি প্রান্তে রয়েছে প্রবাহিত প্রাণের মুক্তির হাতছানি।
কিংবা দোঁহে উদার বাঁধা ঘাটে
অঙ্গে দেব গেরুয়া বাস টেনে
দেখবে কেউ নখ বা কেউ জটা
কানা কড়িও কুঁড়েয় যাবে ফেলে।
সরলতা ভরা নিভৃত প্রাণের মুক্তির ইশারা শহরে এসে খুঁজে পায়নি বধূটি। জেনেছে এ শহর প্রাণহীন। ইঁট পাথরের লোহার খাঁচায় মানুষের হৃদয় নিয়ে নিদারুণ রসিকতা করাই এদের লক্ষ্য। সমাজ অর্থনীতির চোরা স্রোত শহরের মানুষের হৃদয়কে সবক্ষেত্রেই বিনিময় সম্পর্কে বিশ্বাসী করে তুলেছে। লাভ-লোভ আর ক্ষমতার পিছনে ছুটতে ছুটতে শহরের বধূটি জেনেছে যত বড়ো তার সেই হৃদয়পুর, তত বড়ো নয় এ রাজধানী। বিত্তবান হওয়ার ক্রমপরিণতি মানুষকে এমনভাবে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে যে হৃদয় থেকে মায়া-মমতা ভালোবাসার মতো প্রবৃত্তিগুলিকে মুছে ফেলতেও তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। বাণিজ্য আসলে এ শহরে মাশুল ছাড়াই সম্ভব। সদ্য গ্রাম ছেড়ে আসা তরুণী বধূটি পুঁজিবাদ আর ধনতন্ত্রের নিপুণ শরনিক্ষেপ লক্ষ্য করে নিজের অভিজ্ঞতার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে নিয়েছে,
“পাষাণ কায়া, হায় রে, রাজধানী
মাশুল বিনা স্বদেশে দাও ছেড়ে
তেজারতির মতন কিছু পুঁজি
সঙ্গে দাও, পাবে দ্বিগুণ ফিরে।”
জীবন-যাপনের এই অসৎ সামাজিক-আর্থিক সম্পর্ক অতি সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলিকে ক্রমশই ঋণভারে জর্জরিত করে তোলে। মুনাফালোভী এইসব সুদব্যবসায়ীর তাড়নায় নাগরিক মানুষের জীবনের আকাশটাই হারিয়ে যায়। বধূটির কণ্ঠে তাই মূল্যবোধহীন হৃদয়হীন এ শহরে মুনাফা সর্বস্ব নাগরিক জীবনের বেদনা ও অর্থহীনতা তীর্যকভাষায় প্রকাশিত। তেজারতির মতন কিছু পুঁজি থাকলেই এ শহরে টিকে থাকা সম্ভব। নগরের পথে পথে মুনাফা সন্ধানী সুদখোর ব্যবসায়ীর তাড়না তাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বধূটির ভাষ্যে,
“দ্বারের ফাঁক দেখতে পাই যেন
আসছে লাঠি উঁচিয়ে পেশোয়ারী
ব্যাকুল খিল সজোরে দিই মেলে।”
শহর কলকাতাতেও শরতের রাতের আকাশে চাঁদের আলোর বন্যা নামে। কিন্তু জীবনের নির্মল আনন্দে চাঁদের আলোয় নিমগ্ন হবার উপায় থাকে না বধূটির। সে তখন পাওনাদারের ভয়ে দরজায় খিল তুলে দিতে ব্যস্ত। তারায় ভরা জ্যোৎস্না রাতের আকাশে ঋণগ্রস্ত জীবনে মুক্তির হাতছানি নিয়ে আসলেও বিরুদ্ধ পরিবেশের প্রতিকূলতায় তা সম্পূর্ণই অর্থহীন হয়ে যায়। এইভাবে যে মানুষটির হাত ধরে গ্রামের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে শহরের ইঁট-কাঠ-পাথরের কংক্রীটে ভরা পথে সে পা দিয়েছিল, অর্থনৈতিক মন্দার জালে জড়িয়ে ঋণভারে জর্জরিত হতে হতে সেই মানুষটিই অসহায় বধূটির প্রতি সমস্ত দায়িত্ব ভুলে একদিন ফেরারী হয়। পাড়া প্রতিবেশির সন্দিগ্ধ দৃষ্টি, কৌতূহলী আচরণে বিপর্যস্ত হতে হতে বধূটি কীভাবে যেন পরম নিশ্চিত্ততার অর্থাৎ মৃত্যুর কথাও ভাবে। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন এই বধূটির মনে জীবনের সবকিছু থেকে নিজেকে বিযুক্ত করার একটি মানসিকতা তৈরি হয়। অপ্রেমের জগতের সবচেয়ে বড় অসহায়তার বোধই মৃত্যুর নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থানটি রচনা করতে চায়। এই বিপর্যস্ত জীবনের কথা বলতে গিয়ে বধূটি বলেছে,
“ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম
উধাও, লোকলোচন উঁকি মারে
সবার মাঝে একলা ফিরি আমি
লেকের কোলে মরণ যেন ভালো ।”
কিন্তু মরতে গিয়েও বধূটি যেন বোঝে নাগরিক পৃথিবীতে তার মতো মেয়ের মৃত্যুও অর্থহীন। তাই বিপর্যস্ত জীবনের এই গ্লানিতে নিঃশেষ হতে হতেও ‘পাষাণ কায়া’ এ রাজধানীর প্রতি অভিমানে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেনি সে। শুধু ভেবেছে ‘মরণ যেন ভালো’ অর্থাৎ মৃত্যুকে সে চায়নি, কিন্তু জীবনের ব্যর্থতা, প্রেমের ব্যর্থতা তাকে মৃত্যুর কথা ভাবিয়েছে। সমস্ত কলকাতা শহরে সে নিঃসঙ্গ, অপমানিত ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত। আসলে সুভাষ মুখোপাধ্যায় দেখতে চেয়েছেন অবক্ষয়ের পঙ্কিল স্রোতে গ্রামের প্রাণময়ী একটি সত্তা কীভাবে কদর্য অন্ধকারে হারিয়ে যায়। নাগরিক অস্তিত্বের প্রতি এই অর্থহীন গ্লানির অভিজ্ঞতাই কবিতার ভাষাকে এতখানি তীর্যক ও ব্যঙ্গপূর্ণ করে তুলেছিল সেদিন। বধূটি তীর্যক কটাক্ষে এ নগরের পথে ঘাটে অর্থহীন মৃত্যুর ছবিটিও দেখে নিয়েছে। বুঝে নিয়েছে চোখের জল, মনের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলি আসলে এ শহরের পাথরে চিরদিনই মাথাকুটে মরবে। সংহত বাক্বিন্যাসে তীব্র হয়ে উঠেছে তাই কবিতাটির অন্তিম পংক্তিগুলি,
“বুঝেছি কাঁদা হেথায় বৃথা ; তাই
কাছেই পথে জলের কলে, সখা
কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে
গলির মোড়ে বেলা সে পড়ে এল।”
‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বধূ’ কবিতাটি এই বিশ্বযুদ্ধোত্তর পুঁজিবাদী সমাজ সভ্যতার প্রেক্ষাপটে মুনাফালোভী নাগরিক মানুষের সার্বিক অবক্ষয়ের দলিল। বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক সংকট, কালোবাজারি, নেতৃবর্গের স্বজনপোষণ নীতি ও ক্ষমতার নগ্ন রাজনীতি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিকে যে নিদারুণ সর্বনাশের পথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল তারই প্রতিফলক ‘বধু’ কবিতা। গ্রামের সীমা ভেঙে মানুষের শহরে এসে ওঠা যে আর এক বিপন্ন জীবনে প্রবেশের পথ কাটা—সেকথাই তীর্যক বাকবিন্যাসে বলতে চেয়েছেন কবি। হৃদয়ের অকৃত্রিম অনুভব যে শহরের কানাগলিতে ঘুরপাক খেতে খেতে অর্থহীন পলায়ন বৃত্তির মনোভাব তৈরি করে, সেই মানসিকতাকে মেনে নিতে পারেননি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। যুগগত ক্রান্তিলগ্নটিকে চিহ্নিত করে, বিশ শতকের প্রথমার্ধের কলকাতার আর্থ সামাজিক পরিবেশের অবক্ষয়কে তুলে ধরার জন্যই কবির উচ্চারণভঙ্গি এমন তীর্যক ও ব্যাঙ্গাত্মক হয়ে উঠেছিল। বেশ কিছু ভাবনা, চিত্রকল্পের বিন্যাস এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্যে। ‘পুরনো সুর ফেরিওয়ালার ডাকে’ এই শব্দবন্ধটির মধ্যে দিয়ে বিগত শতকের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া যে রয়েছে সেই যুগগত অনুভবকে মাত্রা দেওয়া হয়েছে। উনিশ শতক যে ফুরিয়ে আসছে এই ভাবনাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ‘দিনের আলো নিভে আসা’র প্রসঙ্গে। বিশ শতকের আগমন যে যুদ্ধের দামামা বাজিয়েই উঠে আসছে আর সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী, ধনতান্ত্রিক সভ্যতার গ্লানি নাগরিক মানুষকে সে ক্রমশই হৃদয়হীন করে তুলছে তার প্রমাণ রয়েছে ‘পাষাণ কায়া এ রাজধানী’ শব্দবন্ধটির মধ্যে।
এভাবেই গ্রামজীবনের নিবিড় সুখানুভূতির স্পর্শ দিতে দিতেই নাগরিক জীবনের আপাত অসুস্থতার চিত্রকল্পগুলি ছড়িয়ে দিয়েছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘বধূ’ কবিতাটির ছত্রে ছত্রে। আঙ্গিক কুশল কবি হিসাবে নাগরিক চাতুর্য ও বাগভঙ্গির লক্ষ্যভেদ ক্ষমতায় গভীর আত্মবীক্ষার জাগরণ ঘটিয়েছেন। নাগরিক জটিলতার প্রতীকেই মধ্যবিত্তের তাবৎ অবক্ষয়কে অস্থির সময়ের জটিলতায় প্রত্যয়লিপ্স করে তুলেছেন তিনি। ‘বধূ’ কবিতায় ব্যঙ্গপ্রবণ বাকবিন্যাস এজাতীয় প্রবণতার একটি মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে একথা বলা যায়।
আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।