ছোটোগল্প হিসাবে রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্পটির সার্থকতা বিচার করো

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “ছোটোগল্প হিসাবে রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্পটির সার্থকতা বিচার করো” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

ছোটোগল্প হিসাবে রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্পটির সার্থকতা বিচার করো

বিশ্ববন্দিত কবি রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের অন্যান্য ধারার মতোই ছোটোগল্পের ক্ষেত্রেও উচ্চ আদর্শে নজির রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক প্রকার গল্প রচনা করেছেন—প্রেম বিষয়ক, সমাজ-সমস্যামূলক, অতিপ্রাকৃত বিষয়ক। ‘নিশীথে’ গল্পটি শেষোক্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এই গল্পটির ‘সাধনা’ পত্রিকার ‘মাঘ’ সংখ্যায় ১৩০১ বঙ্গাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। অতিপ্রাকৃত বিষয়ক গল্পগুলির মধ্যে ‘নিশীথে’ গল্পটি একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। অতিপ্রাকৃত একটি বিশেষ রস। তাহাতে রোমাঞ্চ হবে, গা শিরশির করে উঠবে, পিছনে তাকাতে ভয় হবে অথচ সে লোভ সংবরণ করাও সহজ হবে না, আর গল্প পড়া শেষ হয়ে গেলে অন্ধকার ঘরে একাকী প্রবেশ করতে দ্বিধাবোধ হবে। আরও অনেক লক্ষণ থাকতে পারে কিন্তু এগুলিই অতিপ্রাকৃতক গল্প হিসাবে ‘নিশীথে’ গল্পটি একটি সার্থক ছোটোগল্প কিনা সেটাই আমাদের বিচার্য্য বিষয়।

‘নিশীথে’ অতিপ্রাকৃত লক্ষণাক্রান্ত গল্প বলে কথিত হলেও এর মর্মমূলে আছে মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ নির্দেশনা। এর বহিরাবণে অতিপ্রাকৃত বাতাবরণ, কিন্তু ভেতরের তাৎপর্যার্থে মনস্তত্ত্বের গভীরতর চেতনার উদ্ঘাটন। যে বিকার দ্বিতীয় স্ত্রীকে প্রণয় সম্ভাষণ ও প্রণয় চিহ্নের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে তার অনেক গভীরে আছে একটি নারীর প্রতি অমানুষিক আচরণ, যে তার অসুস্থতার সময় জীবনপাত করে নিজের অঙ্গে সুস্থতার চিহ্ন মুছে ফেলেছে ; তার কাছে হতাশ ও আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতার অভাব অন্য একটি অল্প বয়স্কা উদ্ভিন্ন যৌবনার কাছে প্রাপ্তির আশায় ইচ্ছাকৃত অবহেলা তাঁর মৃত্যুকে কাছে টেনে এনেছিল। প্রণয়বুভুক্ষু হয়েও অবচেতনায় তাঁর স্থান স্থায়ী হয়ে সমাসীন ছিল। তাই রাত্রিকালে ব্যাকুল প্রণয়পিপাসায় চেতনস্তর পেরিয়ে অবচেতনায় আত্মকৃত পাপবোধ তাকে পীড়িত না করে পারেনি। পদ্মাতীর সংলগ্ন এলাকায় দক্ষিণাচরণ ও মনোরমা যখন দুজনে বসিয়া পরস্পর প্রেমালাপ করছিল এবং “আমি তাহার সেই জ্যোৎস্নাবিকশিত মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া চুম্বন করিলাম”, অমনি দক্ষিণাচরণের অবচেতন মনে কে যেন ধাক্কা দিয়ে উঠল—“সেইসময় সেই জনমানবশূন্য নিঃসঙ্গ মরুভূমির মধ্যে গম্ভীর স্বরে কে তিনবার বলিয়া উঠিল, ‘ও কে? ও কে? ও কে?’

জীবন-মৃত্যুর সূক্ষ্ম ব্যবধানের মধ্যে একবার প্রাক্তন জীবনে একবার বর্তমান জীবনে তাকে ঘুরপাক খেতে হয়েছে। এই কারাবৃত্তির হাত থেকে তার নিস্তার নেই, প্রখরতর্পণতাপে অনায়াসে অবচেতনা ঘুমন্ত থাকে। কিন্তু নিশীথরাতে কালিমায় সমস্ত পৃথিবী যখন রহস্যাবৃত বলে মনে হয় তখন সুপ্তি থেকে পাপবোধ জাগ্রত হয়; চেতনায় বারবার আঘাত হানে, দংশিত বিবেক ‘নিদারুণ জ্বালা অনুভব করে যার বহিঃপ্রকাশ অশ্রুত শব্দরাজি। যখন সে বলে ওঠে—“মনোরমা, তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না, কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমাকে আমি কোনোকালে ভুলিতে পারিব না”। কথাটি বলামাত্রই নিজের হৃদয়ে নিজেই দংশিত হতে লাগিল। এইভাবে তার মনোগহনে বারবার দ্বিধান্বিত হয়েছে সে। আতধ্বনি পদ্মার একূল থেকে কূলাস্তরে বয়ে যায়; শরীরে জাগে শিহরণ, উন্মাদনায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয় রমনীয় রমণীটিকে ভোগের স্পৃহা অন্তর্হিত হয়ে যায়, যতই তার নিকটবর্তী হয় বিবেকের দংশন ততই তীব্র হতে থাকে। এই বিকারগ্রস্থতা, বিকার মস্তিষ্ক গল্পের উপপাদ্য বিষয়, তার অনুষঙ্গ তামসরজনী—এমনকি, জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে জনশূন্য পদ্মার চরে যে সুখ নীড় গড়ে তোলা সম্ভব ছিল, বাসনায় তীব্রতা ছিল, প্রেম-উন্মুখ তন্ময়চিত্ত অপেক্ষমান ছিল, পরিবেশের এত আনুকূল্য সত্ত্বেও মনের গভীরলোক থেকে আতঙ্ক ও শঙ্কা উঠে এসে শরীর মনের স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দেয়।

নিশীথের অর্থ যেমন এর মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায়, মনোবিকলনের ছবিটিও স্বচ্ছন্দে উপলব্ধি করা যায়। এটিই রবীন্দ্রনাথের ইপ্সিত ছিল, অতিপ্রাকৃতের চেতনার মুখ্য ছিল না। গল্পে কখনও। তাই প্রমথনাথ বিশী রবীন্দ্রনাথের অতিপ্রাকৃতরসের গল্প সম্বন্ধে বলেছেন—

“রবীন্দ্রনাথ যথার্থ অতিপ্রাকৃত গল্প একটিও লিখিয়াছেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। অতিপ্রাকৃত বলিয়া কথিত তাঁহার অধিকাংশ গল্পই রসোত্তীর্ণ ; কিন্তু সেগুলিতে যথার্থ অতিপ্রাকৃতের রস আছে কি ?” রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব উপলব্ধি থেকে প্রমথনাথের এই মন্তব্য সহজেই মেনে নেওয়া যায়। মনের অন্তঃস্থলের চিত্র প্রদর্শনই লেখকের উদ্দেশ্য ছিল, প্রেমিক দক্ষিণাচরণের বাসনা-ইপ্সা ধীরে ধীরে বিকলনের পর্যায়ের দিকে গিয়ে কীভাবে তাকে আলোকিত করতে পারে তা গূঢ়ার্থে ধরা পড়ে। সে কারণে বাইরের অতিপ্রাকৃত উপকরণ গল্পের কেন্দ্রভূমিতে আসতে পারেনি। লেখক বোঝাতে চেয়েছেন বাইরের জগতের নানান উপাচার ব্যাহত পরিদৃশ্যমান, তার অন্তরলোক অন্য কিছু প্রত্যাশা করে।

‘নিশীথে’ গল্পটির সঙ্গে এডগার এলান পো-র ‘লিজিয়া’ ও মোরেল্লা’ গল্পটির আশ্চর্য্য্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এমনকি পো-র গল্প এবং রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্প বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উভয়ের মধ্যে শুধু চরিত্রগত বা ঘটনাগত মিলই নেই, ভাষাগত মিলও রয়েছে। ‘নিশীথে’ গল্পের বহু বর্ণনায় বা সংলাপে পো-র গল্পের বর্ণনা বা সংলাপের হুবহু মিল দেখা যায়। এইসব মিল থাকা সত্ত্বেও বলা যায় আকারগত ও চরিত্রগত মিল থাকলেও উদ্দেশ্যগত মিল ছিল না। উভয়ের উদ্দেশ্য ভিন্ন প্রকৃতির।

ছোটোগল্পের বিশেষ লক্ষণ অনুযায়ী ‘নিশীথে’ গল্পটির হঠাৎ চপলতার সৃষ্টি করে শেষ হয়ে গেছে দক্ষিণাচরণের মনের জটিলতা তাকে বারবার জ্বালিয়েছে। তাই সে ডাক্তারকে নিজের গল্প বলার সময় কখনও থেমে গেছে আবার কখনও আবেগে আপ্লুত থেকেছে। তাঁর মনোগহনের পরিচয় পাই—“শিষ্ট-সম্ভাষণমাত্র না করিয়া অকস্মাৎ উঠিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন।” সেইদিনই আবার ‘আমার দ্বারে আসিয়া ঘা পড়িল, ডাক্তার ! ডাক্তার! অর্থাৎ ছোটোগল্পের বৈশিষ্ঠ্য বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়েছে।

‘নিশীথে’ গল্পের সার্থকতার মূলে উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণতাই দ্রষ্টব্য। দক্ষিণাচরণের বাইরের আচরণ তাকে শেষ পর্যন্ত কী মর্মান্তিক পর্যায়ে এনে তুলে ধরেছে, গল্পের মৌল বস্তু বিশ্লেষণে তাই ধরা পড়েছে। নিছক অলৌকিকতা নিয়ে কারবারে রবীন্দ্রনাথ কখনোই রাজি ছিলেন না, অন্তরের কথা টেনে বের করাই তাঁর উদ্দিষ্ট ; ‘নিশীথে’ গল্পটির অনুসন্ধানী পাঠকের তা বুঝতে অসুবিধা হয় না বলে এর সার্থকতা, রবীন্দ্র গল্পজগতে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আসন এ কারণেই।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment