দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার – ভাবসম্প্রসারণ

প্রিয় শিক্ষার্থীরা কেমন আছো আশা করি ভালো আছো, আজকে তোমাদের জন্য আমরা নিয়ে এসেছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভাবসম্প্রসারণ “দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার ”। চলো এই ভাবসম্প্রসারণটি পড়ে নেয়।

দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার - ভাবসম্প্রসারণ

দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: ন্যায়বিচারে বিচারককে থাকতে হয় নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ বিচারে দণ্ডিতের জন্য তার সহানুভূতি থাকলেও তা তার সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে না।

সম্প্রসারিত ভাব: আইনের চোখে সবাই সমান। তাই আইনের শাসন প্রয়োগকারী বা বিচারককে থাকতে হয় সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে গিয়ে বিচারককে হতে হয় কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। কখনো কখনো দণ্ডিতের সাথে সম্পর্ক, দণ্ডপ্রাপ্তের বয়স প্রভৃতি বিচারককে মানসিক দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। কিন্তু সত্যাশ্রয়ী বিচারক মানসিকভাবে যত বিপর্যস্তই, আবেগে যতই উদ্বেলিত হন না কেন তিনি অন্যায়কারীর প্রাপ্য শাস্তিই দেন। কেননা সামাজিক শাস্তি-শৃঙ্খলা ও মানুষের অধিকার সংরক্ষণে তার দায়িত্ব অপরিসীম। উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে সমাজের খারাপ লোকেরা বাধ্য হয়েই সংযত জীবনযাপন করে। পক্ষান্তরে সামাজিক প্রতিপত্তি বা ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদে যদি কোনো অপরাধীর বিচার বা শাস্তি না হয় তাহলে সমাজে অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সেজন্যে দায়িত্বশীল বিচারক আবেগতাড়িত হন না। তিনি চালিত হন ন্যায় ও আইনের দ্বারা। হযরত উমর (রা)-এর পুত্র আবু শাহমার বিরুদ্ধে মদ্যপান ও ব্যভিচারের অভিযোগ ওঠে। হযরত উমর (রা) নিজে পুত্রের শাস্তি বিধান করেন। নিজ হাতে বেত্রদণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি পুত্রের প্রাণ সংহার করেন। প্রিয় পুত্রের অকাল মৃত্যুতে তাঁর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল সত্য কিন্তু পুত্রস্নেহ তাঁকে ন্যায়বিচার থেকে বিরত রাখতে পারে নি। অপরদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত হতে পারে কিন্তু বিচারকের আন্তরিক সহানুভূতি ও অনুসন্ধান থেকে যেন সে বঞ্চিত না হয় সেদিকটি বিচারককে খেয়াল রাখতে হয়। বিচারককে ভাবতে হয়, দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি একজন মানুষ, কারো পুত্র-কন্যা, কারো আপনজন। একজন মানুষ হিসেবে তার দুর্ভাগ্যে বিচারক যদি মর্মাহত হন তাহলে সেটি হবে একান্ত মানবিক। বিচার হিসেবেও সেটি শ্রেষ্ঠ।

মন্তব্য : ন্যায়বিচারে আবেগ ও সহানুভূতির কোনো স্থান নেই। বিচারকের হাত-পা আইনের অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।

বিকল্প ১

মূলভাব : বিচারকের কাজ অপরাধীর শাস্তি বিধান করা। কিন্তু প্রকৃত বিচারক সে ব্যক্তি যে অপরাধীকে শাস্তি দিতেগিয়ে তার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন।

সম্প্রসারিত ভাব : ন্যায়-অন্যায় নিয়েই আমাদের কর্মজীবন। ন্যায়-নিষ্ঠা সর্বত্র সাধুবাদ পেয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, অন্যায়কারী হয় দণ্ডিত। কিন্তু বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে বুঝিয়ে দিতে হয় যে, অপরাধ নিন্দনীয়। ন্যায়বিচার ঘৃণা করে পাপকে, পাপীকে নয়। বিচারকের জন্য সে কথাই প্রযােজ্য। প্রকৃত বিচারক সমদর্শী, ন্যায় ও সত্যের জীবন্ত বিগ্রহ। তিনি সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হন না। তাঁর কাজ বড় দায়িত্বপূর্ণ। ন্যায় ও সত্যের মর্যাদা রক্ষার জন্য তিনি অপরাধীকে দণ্ডের আদেশ প্রদান করেন বটে, কিন্তু সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে দণ্ডাদেশ উচ্চারণ করতে তিনি দণ্ডিতের জন্য দুঃখ অনুভব করেন। তিনি মনে করেন, দন্ডিত ব্যক্তি তারই মতাে একজন মানুষ। কোনাে মানুষই অপরাধী হয়ে জন্মেনি। জন্মানাের পরই সে অপরাধ করে। হয়তাে রিপুর তাড়নায় অথবা লােভের বশবর্তী হয়েই সে এ কাজ করে। ব্যক্তি মানুষের অপরাধ প্রবণতার পেছনে কেবল যে ব্যক্তি নিজে দায়ী থাকে তা নয়, অনেক সময় পরােক্ষভাবে সমাজও তাকে অপরাধপ্রবণ করে তােলে। তাই যে বিচারক অপরাধীকে দণ্ড দিতে গিয়ে তার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং নিজেকে দণ্ডিত ব্যক্তি বলে ব্যথিত হন তাঁর বিচারই হবে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচার। অর্থাৎ নিরপেক্ষতার সাথে সহানুভূতির মাত্রা যােগ হলেই বিচার মানবিক রূপ পায়, এর শ্রেষ্ঠত্ব তখনই।

মন্তব্য : যে বিচারক দন্ডিতের ব্যথায় ব্যথিত হন, তিনিই প্রকৃত বিচারক। আর তার কাছ থেকেই ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করা যেতে পারে।

বিকল্প ২

ন্যায়বিচার একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ব্যাপার। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রবণতা রোধ করার স্বার্থে অপরাধীর দণ্ডদানের ক্ষেত্রে আবেগ বা ভাবালুতার যেমন স্থান নেই, প্রতিহিংসা বা কোনো পূর্বধারণার প্রভাবও পরিহার্য। অবিচল ধৈর্য এবং নিরপেক্ষভাবে বিচার করাই কাঙ্ক্ষিত, যদি অপরাধীকে দণ্ডিত করতে হয়, তা ক্রোধ বা ঘৃণা সহযোগে না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এতে অবিচারের সম্ভাবনা থেকে যায়। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার সঙ্গে সহানুভূতির মাত্রা যোগ হলেই বিচার মানবিক রূপ পায়, এর শ্রেষ্ঠত্ব তখনই।

আধুনিক সমাজে বিচারের মূল লক্ষ্য প্রকৃত অপরাধীর যথাযোগ্য শাস্তি বিধান এবং সেই সঙ্গে নিরপরাধের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য তখনই সাধিত হবে যখন বিচারে প্রামাণিক সাক্ষ্য ও মানবিক বিবেচনার সমন্বয় ঘটবে। পূর্বধারণার প্রভাবদুষ্টতা তো বটেই, পেশাদারি নির্লিপ্ত মনোভাবও এখানে কাম্য নয়। অভিযুক্ত বা অপরাধী ব্যক্তি প্রথমত একজন মানুষ। সে আমাদের সমাজেরই একজন। ব্যক্তিমানুষের অপরাধ প্রবণতার পিছনে কেবল যে ব্যক্তি নিজে দায়ী থাকে তা নয়, অনেক সময় পরোক্ষভাবে সমাজও তাকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। তাই অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে তার প্রতি মমত্ববোধ সর্বদাই একটি কাঙ্ক্ষিত গুণ। বিচারকের কাছেও এটা আশা করা যায়। অপরাধীকে যান্ত্রিকভাবে শাস্তি বিধানের চেয়ে তার মধ্যেকার শুভচৈতন্যকে জাগ্রত করে তাকে সমাজ জীবনের কল্যাণধর্মী মূলস্রোতে পুনরায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দণ্ড বিধান করতে হলে বিচারককে হতে হয় সমব্যথী ও সহানুভূতিশীল। তবে এই মমত্বের অর্থ এই নয় যে, বিচারক গুরু পাপে লঘু দণ্ড দেবেন। তাহলে মমত্ববোধই আইনকে প্রভাবিত করবে। বিচারক অবশ্যই তাঁর পবিত্র দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ আসন থেকে নিরপেক্ষবাবে পবিত্র দায়িত্ব পালন করবেন। তবে তিনি যদি নিজেকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচারকের ভূমিকা পালন করেন, যদি দণ্ডিতের শাস্তির বেদনায় ব্যথিত হন এবং তাঁর বিচার যদি নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক না হয় তবে সে বিচার শ্রেষ্ঠ বিচার। কারণ, আসামির প্রতি সহানুভূতিশীল থেকেও বিচারক যদি তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য হন, তবে সেই বিচারের সৌক্তিকতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকে না। দণ্ডিত স্বজন হন বা অপরিচিত হন, বিচারের চিরায়ত মনুষ্যত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত বিচার সর্বাবস্তায় আইনের সুপ্রয়োগে সাহায্য করে। তাহলেই বিচার হয় সার্থক।

আরো পড়ুন: নহে আশরাফ যার আছে শুধু বংশ পরিচয়, সেই আশরাফ জীবন যাহার পুণ্য কর্মময়

আশা করি তোমরা এই ভাবসম্প্রসারণটি বুঝতে পেরেছো। আমাদের সাথেই থাকো।

Leave a Comment