মৌর্য সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন

আমাদের সবার ইতিহাস জানা দরকার। তার মধ্যে “মৌর্য সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন” এই বিষয়টি অবশ্যই জানতে হবে। এটি জানলে আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে আরো ধারণা বেড়ে যাবে। আসেন যেনে নেয়।

মৌর্য সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন

খ্রিষ্টপূর্ব ২৩২ অব্দে অশোকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মৌর্য সাম্রাজ্যের গৌরব-রবি অস্তমিত হয় এবং পরবর্তী মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ব্যাক্‌ট্রীয় গ্রীকদের আক্রমণে ঐ অঞ্চল মৌর্য শাসনের বাইরে চলে যায়। অন্যদিকে দক্ষিণদিকে সাতবাহনদের একাধিপত্য মৌর্যদের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে ফেলে। অতঃপর অশোকের উত্তরসূরীরা পূর্ব ভাগে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে পাটলিপুত্রকে কেন্দ্র করে পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশক কোনক্রমে মৌর্য শাসন টিকিয়ে রেখেছিলেন। পুরাণ মতে, পুষ্যমিত্র সুঙ্গের বিদ্রোহ ও ক্ষমতা দখল (খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৭ অব্দ) মৌর্য শাসনের শেষ রেশটুকুও মুছে দেয়।

মৌর্য সাম্রাজ্যের অবনতি ও পতনের কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকেরা নানামত ব্যক্ত করেছেন। বহুকাল পূর্বে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তৎকালীন সমাজের সর্বাধিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী ব্রাহ্মণদের অসন্তোষ ও বিরূপতার উল্লেখ করেছেন। ব্রাহ্মণশ্রেণীর মৌর্য শাসন বিরোধী মনোভাবের উৎস তিনি অনুসন্ধান করেছেন মূলত সম্রাট অশোকের কিছু নীতি ও কর্মধারার মধ্যে। পণ্ডিত শাস্ত্রী ব্রাহ্মণ শ্রেণীর ক্ষোভের বহুমুখী উৎসরণ লক্ষ্য করেছে।। প্রথমত, অশোক বৌদ্ধধর্মের প্রতি আসক্তি বশত এমন কিছু নির্দেশিকা জারী করেছিলেন, যা ব্রাহ্মণদের প্রচলিত সামাজিক অধিকার ও কর্তৃত্বের পক্ষে শংকার কারণ ছিল। তিনি অহিংস নীতি থেকে পশুবলি নিষিদ্ধ করার পক্ষে নির্দেশিকা জারী করেছিলেন। এর ফলে যাগ-যজ্ঞে বলিদান প্রথা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। অথচ যজ্ঞ ও বলিদান প্রক্রিয়া পরিচালনা দ্বারা ব্রাহ্মণ শ্রেণীর প্রতিপত্তি ও সম্পদ রক্ষার অধিকার এতকাল ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত, পণ্ডিত শাস্ত্রীর মতে, অশোক ‘ধর্মমহামাত্র’ পদ সৃষ্টি করে সরাসরি ব্রাহ্মণদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় কর্তৃত্বের একচেটিয়া অধিকার ভেঙ্গে ফেলার প্রয়াস হিসেবেই ব্রাহ্মণরা এটিকে বিবেচনা করে অশোকের বিরুদ্ধাচারণের পথে এগোতে বাধ্য হয়েছিলেন। তৃতীয়ত, পণ্ডিত শাস্ত্রী অশোকের প্রথম অপ্রধান শিলালেখর পঞ্চম অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেছেন যে, অশোক এতদিন যাদের ‘ভূ-দেব’ মনে করা হত (অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের) তাঁদের ‘মিথ্যা’ প্রমাণিত করেছেন। এক্ষেত্রে পণ্ডিত শাস্ত্রী ই সেনার্ট (E. Senart) মহোদয়ের অনুবাদটি গ্রহণ করে দেখিয়েছেন যে, অশোক সচেতনভাবেই ব্রাহ্মণদের ইহজাগতিক সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব ভেঙ্গে ফেলার কৃতিত্ব লেখমালার মাধ্যমে প্রচার করেছেন। চতুর্থত, পণ্ডিত শাস্ত্রী ব্রাহ্মণশ্রেণীর অসন্তোষ ও সাম্রাজ্যবিরোধী মনোভাবের জন্য অশোক প্রচারিত ‘দণ্ডসমতা’ ও ‘ব্যবহারসমতা’ নীতির উল্লেখ করেছেন। পণ্ডিত শাস্ত্রীর মতে, ব্রাহ্মণশ্রেণী তাদের প্রতি রাজকীয় প্রশাসনের আচরণ এবং অপরাধের জন্য শাস্তির (দণ্ড) ক্ষেত্রে কিছু ‘বিশেষ অধিকার’ ভোগ করতেন। অশোকের ‘ব্যবহার সমতা’ ও ‘দণ্ডসমতা’ নীতির মাধ্যমে সেই বিশেষ অধিকার ভেঙে ফেলার প্রয়াস লক্ষ্য করে ব্রাহ্মণরা রুষ্ট হয়েছিলেন।

উপরে কথিত যুক্তিসমূহের ভিত্তিতে পণ্ডিত শাস্ত্রী সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৭ অব্দে মৌর্য বংশের শেষ শাসক বৃহদ্রথকে হত্যা করে মৌর্য শাসনের অবসান ঘটানোর নায়ক পুষ্যমিত্র সুঙ্গ বিক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণশ্রেণীর প্রতিনিধি স্বরূপ ছিলেন এবং তাঁর চরম সিদ্ধান্ত ব্রাহ্মণদের ক্ষোভের পরিণতি ছিল। কিন্তু পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র সিদ্ধান্ত সর্বতোভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী তাঁর ‘Political History of Ancient India’ গ্রন্থে পণ্ডিত শাস্ত্রীর যুক্তিগুলির অসংগতি ও ত্রুটি ব্যাখ্যা করেছেন। ড. রায়চৌধুরী প্রথমেই অশোক তথা মৌর্যবংশের বর্ণগত অবস্থান সম্পর্কে পণ্ডিত শাস্ত্রীর ধারণাকে খণ্ডন করেছেন। তাঁর মতে, মৌর্যরা শূদ্রবংশজাত ছিলেন, এ কথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত নয়। এক্ষেত্রে পণ্ডিত শাস্ত্রী পুরাণ গ্রন্থের একটি ভাষ্যের ওপর জোর দিয়েছেন যেখানে বলা হয়েছে যে, ‘মহাপদ্মনন্দের পরে শূদ্র বংশীয়দের রাজত্ব কায়েম হবে’, (‘ততঃ প্রভৃতি রাজানো ভবিষ্যা শূদ্রযোনয়ঃ’)। কিন্তু এই বক্তব্য থেকে ধরে নেওয়া যায় না যে, পরবর্তী সকল রাজাই ছিলেন শূদ্র। বিন্দুসার এবং অশোক যে ক্ষত্রিয় ছিলেন, এমন প্রমাণ আছে। বৌদ্ধগ্রন্থ দিব্যবদানে আছে যে, বিন্দুসার একটি মেয়েকে বলছেন, ‘তুমি নাপিতের মেয়ে আর আমি পুণ্যবান ক্ষত্রিয়’ (‘ত্বংনাপিনী অহং রাজক্ষত্রিয় মুদ্রাভিষিক্ত’)। এই গ্রন্থের অন্যত্র অশোক রাণী তিষ্যা (তিষ্যরক্ষিতা) কে বলছেন, ‘দেবি আমি ক্ষত্রিয়, কি করে পলাণ্ডু ভক্ষণ করি’ (‘দেবি, অহং ক্ষত্রিয় কথম পলাণ্ডু পরিভক্ষয়ামি’)। মহাপরিনির্বাণ সূত্র এবং মহাবংশ গ্রন্থে মৌর্যদের ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। মহীশুর লেখতেও চন্দ্রগুপ্তকে ‘খ্যাতমান ক্ষত্রিয়দের অন্যতম’ বলা হয়েছে। একইভাবে বৌদ্ধদের প্রশ্রয় দান করে অশোক ব্রাহ্মণদের ক্ষুব্ধ করেছিলেন। এমন ধারণাও সঠিক নয়। কারণ, অশোকের ধর্মনীতির ভিত্তি ছিল সহনশীলতা। অশোকের ধর্মমত বা ধৰ্ম্ম চিন্তা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধীও ছিল না; কিংবা বৌদ্ধধর্মের অন্ধ অনুকরণও ছিল না।

ড. রায়চৌধুরী পণ্ডিত শাস্ত্রীর বক্তব্যগুলি যুক্তিসহকারে খণ্ডন করেছেন। প্রথমত, অশোকের পশুবলি নিষিদ্ধ নীতিতে ব্রাহ্মণদের ক্ষুব্ধ হবার কারণ ছিল না। কারণ বিষয়টি সম্পূর্ণ নতুন নয়। ইতিপূর্বে ব্রাষ্মণরাই পবিত্র শ্রুতিতে অহিংসার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয়ত, ‘ধর্মমহামাত্র’ পদ সৃষ্টি করে অশোক ব্রাহ্মণদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছিলেন, এমন ধারণা ভিত্তিহীন। কারণ ধর্মমহামাত্ররা আক্ষরিক অর্থে ব্রাহ্মণদের চিরাচরিত বৃত্তিতে হস্তক্ষেপ করেন নি। এই পদাধিকারীরা মানুষকে ধর্মমুখী করার পাশাপাশি প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করতেন। অশোক এই কর্মচারীদের ব্রাহ্মণদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার নির্দেশও দিয়েছিলেন। তাছাড়া ধর্মমহামাত্র পদে ব্রাহ্মণদের নিয়োজিত হবার ক্ষেত্রেও কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তৃতীয়ত, পণ্ডিত শাস্ত্রী অশোকের প্রথম অপ্রধান শিলালেখর বক্তব্য সম্পর্কে ই. সেনার্ট-এর ব্যাখ্যা গ্রহণ করে ভ্রান্ত ধারণার অনুসারী হয়েছেন। এখানে মূল উদ্ধৃতিটি হল ‘য(ই)-ইমায় কালায় জম্বুদিপসি অমিসা দেবা হুসুতে দানি ম (ই) স-কটা’ অর্থাৎ‍ এতদিন যাদের ‘ভূদেব’ মনে করা হত, আমি তাদের মিথ্যা (দেবতা) প্রমাণ করেছি। এখানে ‘ভূদেব’ বলতে ব্রাহ্মণদের বোঝানো হয়েছে। ড. রায়চৌধুরী মনে করেন যে, সেনার্ট ‘অমিসা’ শব্দটিকে সংস্কৃত শব্দ ‘অমৃসা’র অনুরূপ ভেবে নিয়ে ‘মিসা’ বা ‘মিথ্যা’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সিলভা লেভি যুক্তিসহ বলেছেন যে, ‘মিসা’ শব্দটির অর্থ হল ‘মিশ্র’ বা মিলিত করা। এই ব্যাখ্যা অনুসারে অশোকের বক্তব্যটির পরিবর্তিত অর্থ হল, ‘এতদিন যাঁরা দেবতাদের সাথে অমিশ্রিত ছিলেন, তিনি তাদের দেবতাদের সাথে মিশ্রিত করেছেন। এখানে অশোক অব্রাম্মণ সাধারণ মানুষের সামাজিক উত্তরণের কৃতিত্ব দাবি করেছেন বলে ড. রায়চৌধুরী মনে করেন। সুতরাং এতে শ্রেণী হিসেবে ব্রাহ্মণদের ক্ষুব্ধ হবার মত উপাদান ছিল না। চতুর্থত, অশোকের বিরুদ্ধে পণ্ডিত শাস্ত্রীর আর একটি অভিযোগ হল যে, অশোক ‘ব্যবহার সমতা’ ও ‘দণ্ডসমতা’ দ্বারা ব্রাহ্মণদের বিশেষ অধিকার খর্ব করেছিলেন। ড. রায়চৌধুরী এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেই মনে করেন। কারণ অশোকের ক্ষমতালাভের আগে থেকেই কিছু কিছু অপরাধের দায়ে ব্রাহ্মণকেও প্রাণদণ্ড দেওয়া যেত, কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রে এর আভাস পাওয়া যায়। আসলে, অশোক বিচার বিষয়ে ‘রজুকদের হাতে কিছু অতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে যাতে ন্যায় বিচার ‘লঙ্ঘিত না হয়, সেজন্য অশোক রজুকদের কার্যপ্রণালীর ওপর কিছু নৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার লক্ষ্যে ব্যবহার সমতা ও দণ্ড সমতার কথা বলেছেন। সুতরাং এতে ব্রাহ্মণদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না।

পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ব্রাক্ষ্মণ বর্ণভূক্ত পুষ্যমিত্র সুঙ্গ কর্তৃক মৌর্য রাজা বৃহদ্রথের হত্যাকাণ্ডকে ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়ার পরিণতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এমন ধারণার যৌক্তিকতাও নিঃসংশয়ে মেনে নেওয়া যায় না। মনে রাখা দরকার যে, অশোকের মৃত্যুর চার দশকেরও পরে পুষ্যমিত্রর অভ্যুত্থান ঘটেছিল। একজন নির্দিষ্ট শাসকের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক শ্রেণির ক্ষোভের বিস্ফোরণ প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরে সংঘঠিত হচ্ছে, এমন ধারণা করা যুক্তিসংগত নয়। তাছাড়া সমকালীন সাহিত্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, অশোকের মৃত্যুর পরেই মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙন শুরু হয়েছিল। রাজতরঙ্গিনী, অর্থশাস্ত্র, এবং লামা তারানাথের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, অশোকের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই যথাক্রমে কাশ্মীর, বিদর্ভ ও গান্ধার স্বাধীনতা ঘোষণা করে মৌর্য শাসনের বাইরে চলে গিয়েছিল। সেই ভাঙন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল পুষ্যমিত্র শুঙ্গের অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা দখল।

রাধাকুমুদ মুখার্জীও মনে করেন যে, অশোকের সাথে ব্রাক্ষ্মণ শ্রেণীর সংঘাতের কোন দৃষ্টান্ত নেই। তাঁর মতে, ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্য সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়েছিলেন, একথা সত্য। তবে ব্রাহ্মণশ্রেণীর প্রতিনিধি রূপে নয়, তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবেই ক্ষমতা দখলের জন্য বৃহদ্রথকে হত্যা করেছিলেন। লক্ষ্যণীয় যে, পুষ্যমিত্রর শুঙ্গবংশের উচ্ছেদ সাধনের কাজও করেছিলেন একজন ব্রাক্ষ্মণ, কান্ব বংশের প্রতিষ্ঠাতা বাসুদেব (খ্রিঃপূঃ ৭৫ অব্দ)।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অশোকের দায়-দায়িত্বকে ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী ভিন্ন দৃষ্টি কোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, অশোকের ধর্ম্মনীতির কেন্দ্রে ছিল অহিংসা। অহিংস নীতির প্রতি আসক্তি বশতঃ তিনি রাজধর্ম বিস্মৃত হয়েছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তিনি ‘দিগ্বিজয়’ নীতি বর্জন করে ‘ধর্মবিজয়’ নীতি গ্রহণ করেন। ‘বিহার যাত্রার’ স্থান নেয় ‘ধর্মযাত্রা’ কর্মসূচী। যুদ্ধের ‘ভেরীঘোষ’ পরিবর্তিত হয়ে যায় ‘ধৰ্ম্মঘোষ’-এ। এর পরিণামে সেনাবাহিনী যুদ্ধবিমুখ ও অলস হয়ে পড়ে। অথচ সেই সময় উত্তর-পশ্চিম ভারতে যবন আক্রমণের আশঙ্কা তীব্রতর হয়েছিল। মৌর্য-সিংহাসনে তখন প্রয়োজন ছিল চন্দ্রগুপ্তের মত একজন আগ্রাসী সামরিক নেতার। কিন্তু অশোক ছিলেন একজন বাস্তবতাবর্জিত স্বপ্নদ্রষ্টা শাসক মাত্র। দেশের আঞ্চলিক ঐক্য বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ উভয় ক্ষেত্রেই অশোকের নম্র-আদর্শবাদ আত্মঘাতী হয়েছিল।

এই অভিযোগ প্রসঙ্গে নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী (K. A. N. Shastri ), রোমিলা থাপার প্রমুখ বিরোধী মত পোষণ করেন। অধ্যাপক শাস্ত্রীর মতে, কেবল যুদ্ধ-বিজয় দ্বারা একটি রাষ্ট্রকে দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। ঔরঙ্গজেব গোটা শাসনকাল যুদ্ধে লিপ্ত থেকেও মোগল সাম্রাজ্যকে স্থায়িত্ব দিতে পারেন নি। অন্যদিকে ড. থাপার মনে করেন যে, অশোকের শাস্তিবাদী নীতির পরিণাম সম্পর্কে বহু ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জন করা হয়েছে। তাঁর মতে, অশোক যুদ্ধনীতি বর্জন করেন নি, কিংবা সেনাবাহিনী ভেঙে দেন নি। তিনি বলেছিলেন আর যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া অহিংস নীতি নিলেও সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়োজনে তিনি কঠোর হতে দ্বিধা করেন নি। কলিঙ্গ রাজ্য তিনি ফিরিয়ে দেননি। সীমান্তে উপজাতিদের আন্দোলন দমনের কাজে তাঁর বাহিনীর নৃশংস আচরণের জন্য জনগণের কাছে অনুতাপ প্রকাশ করেন নি। এ. এল. ব্যাসাম এর মতে, অশোকের পূর্ববর্তী রাজারা নিরন্তর যুদ্ধ করেছিলেন, আর অশোক উপজাতিদের সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তাঁদের মানসিক পরিবর্তন দ্বারা। অর্থাৎ অশোক ছিলেন ‘প্রতি ইঞ্চি একজন রাজা’ (every inch a king)। আগ্রাসী যুদ্ধ কিংবা স্বেচ্ছাচারমূলক কঠোরতার নীতি অশোক সচেতনভাবেই পরিহার করে চলেছিলেন। সাম্রাজ্যিক সংহতি রক্ষার কাজে তিনি আপোস করেন নি।

ড. রায়চৌধুরী মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের প্রেক্ষাপটে প্রত্যন্ত প্রদেশগুলির অমাত্যদের অত্যাচার ও জনগণের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এজন্য তিনি অশোকের অহিংস, নম্র নীতিকে বিশেষভাবে দায়ী করেছেন। প্রদেশে অমাত্যদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম গণ-অভ্যুত্থান ঘটে বিন্দুসারের আমলে। অশোকের আমলে তক্ষশিলায় দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ সংঘঠিত হয়। বিদ্রোহীদের শান্ত করার জন্য অশোক যুবরাজ কুনালকে দায়িত্ব দেন। ‘দিব্যবদান’ থেকে জানা যায় যে, বিদ্রোহী জনগণ কুনালের কাছে এসে অমাত্যদের অত্যাচারের বিবরণ দেন ও প্রতিকার দাবি করেন। অশোকের কলিঙ্গ লেখ (জৌগড়া) থেকে এই কাহিনীর সমর্থন পাওয়া যায়। এই লেখতে অশোক তোমালির (কলিঙ্গর রাজধানী) মহামাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে, ‘সকল মানুষই আমার সন্তান। কিন্তু আপনারা এর গভীরতা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন না। …. দেখবেন যেন শাসনকার্যে এই নীতি প্রতিফলিত হয়। অশোক এখানে স্বীকার করেছেন যে, নাগরিকদের অবরোধ সঙ্গত কারণ ছাড়া হতে পারে না। এ বিষয়ে অনুসন্ধান ও সমাধানের উদ্দেশ্যে তিনি নির্দিষ্ট সময় অন্তর তক্ষশিলা, উজ্জয়িনী, কলিঙ্গ প্রভৃতি প্রদেশে প্রতিনিধি দল প্রেরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ড. রায়চৌধুরী মনে করেন, বিভিন্ন প্রদেশে রাজকর্মচারীদের (মহামাত্র/ অমাত্য) স্বেচ্ছাচার এবং কেন্দ্রীয়ভাবে তা নিয়ন্ত্রণের অভাব জনগণকে সাম্রাজ্য বিরোধী করেছিল। তবে রোমিলা থাপার অমাত্যদের অত্যাচারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাননি। তাঁর মতে, অশোকের আমলে অমাত্যদের অত্যাচারের যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তাছাড়া কলিঙ্গ লেখতে অশোকের ভাষ্য যথেষ্ট কর্তৃত্বব্যাঞ্জক। তাহলে প্রজাদের অভিযোগ শোনার জন্য তিনি তিন বা পাঁচ বছর অন্দর ‘মৃদুভাষী ও সংযত’ কর্মীদল পাঠানোর কথা কেন উৎকীর্ণ করেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর রোমিলা থাপার দেন নি।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য একটি বিষয়ে মোটামুটিভাবে প্রায় সব ইতিহাসবিদ একমত হয়েছেন যে, অর্থনৈতিক সংকট চূড়ান্ত পর্যায়ে সাম্রাজ্যের পতন ডেকে এনেছিল। মৌর্য অর্থনীতি নানাদিক থেকে আঘাত পেয়েছিল। অনুৎপাদক খাতে ব্যয়ের ক্রমবৃদ্ধি এবং আয়ের পথ ক্রমশ সংকুচিত হবার ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ভেঙ্গে পড়ে। এ বিষয়ে অশোকের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব আছে বলে ডি. এন. ঝা, মনে করেন। তাঁর মতে, প্রথমত, অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর কোন যুদ্ধ করেন নি। কেবল কুচকাওয়াজ ও জনপ্রদর্শনীর জন্য সেনাদলকে ব্যবহার করা হত। এই বিশাল বাহিনীর অতিরিক্ত ব্যয় রাজকোষকে দুর্বল করেছিল। দ্বিতীয়ত, অশোকের আগে থেকেই রাজকীয় কর্মচারীর সংখ্যা ছিল যথেষ্ট বেশী। অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত কর্মচারীগোষ্ঠীর বাইরেও অশোক বহু নতুন কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে এঁদের কোন যোগ ছিল না। তৃতীয়ত, পিতৃসুলভ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে প্রজাসাধারণের মঙ্গলসাধনের জন্য গৃহীত দাতব্য ব্যবস্থাও রাজকোষকে দুর্বল করেছিল। অধ্যাপক ঝা লিখেছেন যে, বৌদ্ধ সংঘের জন্য তাঁর অত্যধিক দান-ধ্যান রাষ্ট্র ও তাঁর নিজের পক্ষে ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছিল। হিউয়েন সাং-এর বিবরণীতেও অশোকের দরাজ অর্থব্যয়ের সমর্থন পাওয়া যায়।

মৌর্য অর্থনীতির ভিত্তি ছিল গাঙ্গেয় উপত্যকার কৃষি-রাজস্ব। কৌটিল্য সম্পদ বৃদ্ধির জন্য ‘জনপদনিবেশ নীতি’ অনুসরণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু মৌর্যরা গাঙ্গেয় উপত্যকার বাইরে এই কাজে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য পায়নি। দক্ষিণ ভারতে কিছু কর্তৃত্ব থাকলেও সেখান থেকে উদ্বৃত্ত আহরণের কোন সুযোগ ছিল না। অর্থাৎ কেবল গাঙ্গেয় সমভূমির আয় থেকে এই বৃহদাকার সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে হত। গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি-অর্থনীতি স্বচ্ছল হলেও, সাম্রাজ্যের অন্যত্র তা ছিল অনেক পশ্চদপদ। কৃষি এলাকা থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব গোটা সাম্রাজ্যের ব্যয়ভার বহনের পক্ষে পর্যাপ্ত ছিল না। কৌশাম্বির মতে, অভিনেতা ও গণিকাদের ওপর কর ধার্যের ঘটনা অর্থব্যবস্থায় অসহায়ত্বের অন্যতম দৃষ্টান্ত। অধ্যাপিকা থাপার মৌর্য শহরগুলির ধ্বংসস্তূপের নিদর্শন থেকে আর্থিক ক্রমাবনতির তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম পর্বের শহরগুলির ধ্বংসস্তূপে বর্ধিষ্ণু অর্থব্যবস্থার যে ছাপ পাওয়া যায়, পরবর্তী যুগের ক্ষেত্রে তা পাওয়া যায় না। তাছাড়া পরবর্তী যুগের মুদ্রাগুলিতে রূপার পরিমাণ কমিয়ে খাদের পরিমাণ বাড়ানো থেকেও ভেঙে পড়া অর্থনীতির প্রমাণ মেলে। ‘মহাভাষ্য’ প্রণেতা পতঞ্জলি পুষ্যমিত্র শুঙ্গের সমসাময়িক ছিলেন। স্বভাবতই মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তিম পর্বের অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা থাকা সম্ভব। পতগুলি লিখেছেন যে, হিরণ্য সন্ধানী মৌর্য রাজারা দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণে রত ছিলেন (‘হিরণ্যাথিভিঃ মৌর্যে অচ্চাঃ প্রকল্পিতাঃ)। অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্যের একটি ভাষ্য দ্বারা এর ব্যাখ্যা করলে আর্থিক সংকটের চিত্রই স্পষ্ট হয়। কৌটিল্য লিখেছেন যে, অর্থসংকট তীব্র হলে রাজা রাজকোষ পূর্ণ করতে উদ্যোগী হবেন এবং প্রয়োজনে চালাকির আশ্রয় নেবেন। এমন একটি পন্থা হিসেবে তিনি বলেছেন যে, রাজা প্রচার করবেন যে দেবতারা অসন্তুষ্ট হবার কারণে অর্থসংকট এসেছে। দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য পূজার্চনার ব্যাপক ব্যবস্থা করা জরুরী। এজন্য রাজা দেবদেবীর মূর্তি তৈরী করে আরাধনার জন্য জনগণকে প্ররোচিত করবেন এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে সমর্পিত অর্থ-সম্পদ রাজা রাজকোষে জমা করবেন।

মৌর্যদের কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থাও সাম্রাজ্যের পতনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। মৌর্য শাসনব্যবস্থা ব্যবহারিক ভাবে সুগঠিত হলেও আমলাতন্ত্র ছিল অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত। আমলাতন্ত্রের আনুগত্য ছিল রাজার প্রতি। রাজা বদল হলে কর্মচারীদেরও পরিবর্তন ঘটত এবং আনুগত্যও পাল্টে যেত। রাজা ইচ্ছানুযায়ী প্রাদেশিক শাসক ও কেন্দ্রীয় কর্মীগোষ্ঠীকে নিয়োগ করতেন। আবার প্রাদেশিক শাসকরাও তাঁদের অধীন কর্মীদের নিয়োগ করতেন। ফলে স্থানীয় রাজনৈতিক দলাদলি প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। নিরপেক্ষ ও যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থা থাকলে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের বন্ধন দৃঢ় হতে পারত। শাসনক্ষেত্রে জনমতকে প্রতিফলিত করার মত কোন প্রতিষ্ঠান না-থাকায় প্রজাদের দায়িত্ব ও আনুগত্যের ক্ষেত্রটি দানা বাঁধতে পারে নি। মৌর্যদের সুগঠিত ও ব্যাপক গুপ্তচর ব্যবস্থাও জনগণের মতপ্রকাশের ক্ষেত্রটি সংকুচিত করে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছিল।

রোমিলা থাপার মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙনের জন্য রাষ্ট্রচেতনা ও ধর্মচেতনা তথা সমাজবন্ধনের সংঘাতে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, গণরাজ্যগুলির ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণাও চাপা পড়ে যায়। নতুন রাজতন্ত্র ‘রাষ্ট্রের’ ধারণাকে আড়ালে নিয়ে যায় এবং সামাজিক রীতির প্রতি আনুগত্য তৈরী হয়। বর্ণাশ্রম প্রথা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় বন্ধনের স্থান দখল করে সামাজিক বন্ধনের চেতনা। এই সামাজিক বন্ধন ‘ধর্ম’ ভাবনার মাধ্যমে কার্যকরী হয়েছিল। সমকালীন রাষ্ট্রতত্ত্বে রাজা ও তাঁর প্রশাসন যন্ত্রকে সকল ক্ষমতার আধার বলেই মনে করা হত। তবে রাজা ও রাজকীয় প্রশাসনের এই ‘মূর্ত’ কর্তৃত্বের ধারণা, বিমূর্তভাবে ধর্মের ওপরেই ন্যস্ত ছিল। রাজার নৈতিক কর্তব্য ছিল এই ধর্মকে রক্ষা করা। ড. থাপার মনে করেন, ধর্ম বা সমাজব্যবস্থা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হলেও, তার গতি এতটাই শ্লথ ও নীরব ছিল যে তা মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। ফলে আনুগত্যের ক্ষেত্রটি অপরিবর্তিত থেকে যায়। স্থানীয় পর্যায়ে বর্ণ-জাতি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সামাজিক বন্ধন কার্যকরী হবার পরিণামে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় ঐক্যের চেতনা অধরা থেকে যায়।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকেরা তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। ড. নীহাররঞ্জন রায় গণবিদ্রোহের কথা বলেছেন। সম্রাট অশোক কর্তৃক বিদেশী ভাবধারা গ্রহণ এবং অত্যধিক কর আরোপের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ হয়েছিল। তবে অধিকাংশ পণ্ডিত এই বক্তব্য মানতে চাননি। তাঁদের মতে, অশোকের আমলে করের বোঝা অসহনীয় ভাবে বেশী ছিল না। গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল যথেষ্ট উর্বর ছিল। মেগাস্থিনিসের বিবরণ মতে করভার ছিল উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ মাত্র। তাছাড়া গণ বিদ্রোহ করার মত জাতীয় চেতনা কিংবা সন্মিলিত বিদ্রোহ করার মত সামাজিক ঐক্য খ্রিষ্টপূর্ব কালীন ভারতে ছিল না।

যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবও সাম্রাজ্যের পতনে আংশিক দায়ী ছিল বলে রাধাকুমুদ মুখার্জী মনে করেন। তাঁর মতে, সামরিক জড়তা বা অশোকের আদর্শবাদ নয়, সাম্রাজ্যের পতনের উপাদান সক্রিয় ছিল মৌর্যদের শাসন সংগঠনের মধ্যে। এই সুবিস্তৃত সাম্রাজ্যের উপযোগী কেন্দ্রীভূত শাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, দক্ষ প্রশাসকের। অশোকের পরবর্তীকালে দশরথ ছাড়া কেউই তেমন প্রতিভাবান ছিলেন না। এতে কেন্দ্রীয় শাসনের দূর্বলতার সুযোগে রাজুক সহ প্রাদেশিক শাসকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পেয়ে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদের পাল্লা ভারী করেছিল। তাই চূড়ান্ত পতনের বহু আগেই কলিঙ্গ, বিদর্ভ, উত্তর-পশ্চিম ভাগ ইত্যাদি মৌর্য সাম্রাজ্যের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয়েছিল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের ক্ষমতা বৃদ্ধির উল্লেখ মহাভাষ্যে পাওয়া যায়। অশোকের মৃত্যুর পরেই এই এলাকা মৌর্য আধিপত্যের বাইরে চলে গিয়েছিল। এইভাবে ভঙ্গুর ও দুর্বল রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষমতা দখল করা পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পক্ষে খুব কষ্টকর হয়নি।

বস্তুত মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কোন একটি কারণকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় না। মানবশরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতই মৌর্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি একে একে দুর্বল বা অকেজো হয়ে চূড়ান্ত পতন এনেছিল। রাষ্ট্র ব্যবস্থার মেরুদণ্ড অর্থব্যবস্থা, চালিকা শক্তি আমলাতন্ত্র, মস্তিষ্কস্বরূপ রাজা এবং সামগ্রিক জীবনশক্তি জনগণের আনুগত্য ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভাঙ্গন গ্রাস করেছিল যা পরিণামে মৌর্য শাসনের অবসান অনিবার্য করে।

আশা করি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমাদের অন্যান্য পোস্ট ভিজিট করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment